কালের কোলাজ
অপ্রতিম রাজীব
উৎসর্গ: সেই যে আমার ক্লেদাক্ত সব দিনগুলোকে
ডায়েরি
অলিখিত কবিতার মতো অভিমানী উদাসীনতায়
দুঃখিত শূন্যাকাশে মেঘের স্তর জমাটবদ্ধ হয়।
নিঃসঙ্গ ডায়েরির পাতা কাঁপে বৃষ্টি ও উত্তরে বাতাসের ছোঁয়ায়।
পেন্সিলে আঁকা দিনপঞ্জি।
দিন দিন অস্তিত্ব হারাবার পথে
জনৈক বণিকের লব্ধ শব্দকোষ,
জীবন নামের বন্দরে নিত্য যার পদচারণ।
শব্দমালা আবছা সন্ধ্যায়
নিয়মিত তন্দ্রার ঘোরে
আত্মদেহ কেটে মাংস বিক্রি করে।
শব্দপ্রতীক… … … … … ব্যাধগোত্রভুক্ত?
তাই বটে! দিনপঞ্জির ঘন অরণ্যের গভীরে
ওদের পদযাত্রা থেকে নতুন মেঠো পথ হয়েছে।
দেখতে পাও না স্বপ্ন–ময়ূরের মতো
অজস্র তারকালোকিত চোখ?
তপ্ত ঝোলের স্বপ্নে লালায়িত লোল?
ওই যে কাদামাটির বুক চিরে
রক্তের লাল রেখা দিক কেটে গেছে,
ওদিকেই তো শব্দব্যাধ চলেছে তার গন্তব্যপথে।
দেখছো না তার রক্তের রঙে আঁকা রোখ?
শুনছো না ড্রাকুলাকে চমকিত করা
তার পদশব্দ?
মুছে যেতে চায়, তবু টিকে থাকে
চোখের চাহনিতে, জাদুর সংশয়ে,
ঘোর রাত্রির ঘুমে, দুরন্ত ফেনিল স্বপ্নে।
নেই কালির দাগ এতোটুকু,
তবু চোখে পড়ে – যেন লেখা আছে ডায়েরির পাতায় –
“আঁধার বনের গর্ভে ব্যাধ চলে খুনের তৃষায়।”
উদ্দেশ্যের অবোধোদয়ে
ডায়েরির লাল অক্ষর
অবহেলায় পড়ে থাকে গুমোট বদ্ধ ঘরে।
রূপকথার পক্ষিরাজ, অবরুদ্ধা কুমারী ও একচক্ষু দানব
দিশাহীন পরিস্থিতি দেখে
স্মৃতি ও বিস্মৃতির বিদিশায় পলায়ন করে।
জিঘাংসু ব্যাধের দল হত্যা করে পায়রার মিথুন;
নিহত নীলিমার দেহ ক্রুশবিদ্ধ করে।
রাস্তা দিয়ে মাংস নিয়ে
ছুটে যায় সুদীর্ঘ ব্যাধের মিছিল।
এক রাতে
দূরবর্তী সমুদ্রের তীরে
নীল শৈশবের মৎস্যকন্যারা
অজাগতিক ফুলের মাতাল গন্ধ
আমার বাগানে দিলো বইয়ে।
নিরুপায় আকর্ষণে আমি
দরজা খুলে ছুট দিলেম,
তারপর সমুদ্রে ডুব।
গভীর–গভীর–অনন্ত গভীরে ডুবে
পদতল স্পর্শ পেলো সমুদ্রের নন্দনকাননের।
সেখানে অপ্সরা নেই, শুধু অসংখ্য শব্দব্যাধের ভিড়।
একজন আমাকে দেখে মাথা ছিন্ন করে
রক্তাক্ত লাশ নিয়ে কয়েদ করলো সমুদ্রের লাশ–কাটা ঘরে।
তারপর উন্মত্ত জোয়ারের স্রোতে
কোন্ এক নস্ট্যালজিক্ টানে
রক্ত আমার ভেসে গেল পূর্বেকার ভিটেয়।
সেখানে ডায়েরির শিরশিরে পাতাকে জড়িয়ে ধরে
খুঁজে পেলো টকটকে এক অনুভব।
-o-
চাঁদের বুড়ি
(প্রাগৈতিহাসিক কবির বচন)
চন্দ্রপুরে বাস করে কোন্ এক হাড্ডিসার শ্রমজীবী বুড়ি।
আদিহীন অন্তহীন কালকে সম্বল করে সূত্র কাটে তার চরকায়।
দূর নক্ষত্রের আলো চাঁদের মাটিকে করে উজ্জ্বল বৃত্তাকার প্লেইট।
পৃথিবীর জলাশয়ে শূন্যের স্বপ্নময় গোলকেরা সৌন্দর্যের রেচন ঘটায়।
অজস্র রূপালী কণা ভূত্বকে স্বপ্নচিহ্ন হাতড়ে বেড়ায়।
ভূস্ত জীবের চোখে অজস্র আলোকিত স্বপ্ন নাচে।
পুরাণ, রূপকথা, রাত্রির ঘুম
স্বপ্নময় সিল্কের পক্ষিরাজ ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে।
অনুভূতিহীন মৎস্যকন্যারা মাংস বিক্রির কামনায়
পুংলিঙ্গ খোঁজে। এবং বৃদ্ধারও দেহে
দশ সহস্র কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো মৃত পুরুষের প্রতি
অতীতের প্রেম উন্মাদনা হয়ে জেগে ওঠে।
অতীত প্রেমের স্মৃতি আওড়ায় মনে মনে
চরকা–কাটা বুড়ি একা একা।
গোত্রহীন অশরীরী চাঁদের গর্তে ভরা পিঠে
তেরোটি বেগুনি রশ্মি নিয়ে করে খেলা।
সবকিছু তন্দ্রাময়;
স্পষ্ট শুধু পিঠে তার
উত্তরপুরুষের পদচিহ্ন।
-o-
বাঁশি ও বেলুন
কাঠের বাঁশির মুখে আটকানো রবারের বেলুন।
ফুঁ দিয়ে বেলুনকে গর্ভবান করে ছেড়ে দিলে
বাতাস বেরিয়ে আসে বাঁশির মধ্যপথে সুর সৃষ্টি করে।
সে’ উদ্দেশ্যে ফুঁ দিয়ে বেলুনকে স্ফীত করতে করতে–
স্ফীত করতে করতে– স্ফীত করতে করতে–
ঘুমে দেখা স্বপ্নের সবুজ প্রদোষের
প্রকৃত রূপদানে সচেষ্ট হলাম। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে
সে’ বেলুন ফেটে নীল শূন্যে, অরাজকতায়,
আফ্রিকার কালো বনে, শূন্য হ্রদে, স্বপ্নের নীল মদে,
পিগমী নৃত্যে, চৈনিক ড্রাগনের লেজে,
অমর্ত্য রিভেন্ডেলে, পুরাণের ব্যর্থ উচ্চাকাঙ্ক্ষায়,
স্বপ্নময় ডিজনীল্যান্ডে, কোনো এক জনশূন্য গ্রহে –
গতিবান রকেটে চড়ে পরিক্রমণ শেষে বেহুঁশ মাতাল হয়ে
শূন্যের গহ্বরে হাহাকারের এক আঁচড় টেনে রেখে গেলো।
-o-
আলো
অমারাত্রি; মেগাসিটি ঢাকা আলোকিত
লোহিত সোডিয়াম লাইটে, সেই সাথে
প্রোজ্জ্বল বাজারের সব সাইনবোর্ড।
রোডের বুক দুমড়ে দিয়ে ছুটে চলে
সংখ্যাতীত দানবীয় দ্রুত স্পিড্কার।
বস্তিঘরে ল্যাম্প জ্বলে, আর কালু ডোম
প্রদীপ্ত আগুন জ্বালে শ্মশান–চিতায়।
স্ট্রিটে স্ট্রিটে চলে আলোক–সজ্জার খেলা।
ধাঁধা লাগে ক্লান্ত চোখে হাঁটার সময়
নগরীর শীর্ণ ফুটপাথ বরাবর।
চৌরাস্তার মোড়ে চোখে অন্ধকার জাগে;
ঝাঁঝালো লাইট যেন এক নীল ধাঁধা।
ফিরে আসি শূন্য ঘরে অন্ধকার কোণে,
খুঁজে ফিরি আলো শুধু এক প্রদীপের।
-o-
নস্ট্যালজিয়া
“নগরের বুক ছিল সবুজ প্রান্তর
কোনো এক নিঃশব্দ ও নিরব শতকে।
উন্মুক্ত বনের গর্ভে মুক্ত ছিল মন
ও শরীর; মুক্ত ছিল পাতার মর্মর।
শিশির–বিদীর্ণ স্তেপ মর্ত্যে বন্দী হয়ে
হতাশ্বাস হয়ে ছিল বদ্ধ পাতালের।”
– প্রবঞ্চিত ভূমি থেকে আক্ষেপের স্বর
হৃদয় দীর্ণ করে আকাশ ও মর্ত্যের।
মনকে আকৃষ্ট করে বিগত আকাল
নয়তো মরা সুদিন। অতিক্রান্ত কাল
কেমন ছিল – তা জানে শুধুই অতীত।
দু’চোখ স্কেচ কষে নতুন কল্পনায়
স্বপ্নাশ্রিত অতীতের। অলীক সত্তার
বেশ ধরে পূর্ব রাত, সত্য হয় মৃত।
-o-
ঘুড়ি
ইচ্ছের নীল ঘুড়ি পাক খায় আকাশের শূন্য গহ্বরে,
মেঘ ছিঁড়ে উড়ে যায় তারার প্রান্তরে।
নাটাইয়ের সুতো কেটে এককালে হারিয়ে যায়
একান্ত অজানায়
পুরাণের ধূ ধূ সীমাহীন দেশে।
-o-
প্রেম
১.
মোমবাতি অন্ধকার কামরার ভেতর
প্রেমিক সল্তেকে নিয়ে লেলিহান আগুনের
নিদাঘে দগ্ধ হয়।
সল্তে আত্মাহুতি দেয়। ফলস্বরূপ রাত্রির
বুনো হাওয়ায় নৃত্যময় আলোকের
উষ্ণ তরল পড়ে বর্ণহীন দুঃখের অ্যানামেল হয়।
২.
আফ্রোদিতির সঙ্গে প্রেম ও সংগমে যায়
প্রত্যেক প্রেমিক পুরুষ।
অস্থির কালচক্রে রূপ পাল্টে প্রেমিকার;
বার বার বিবর্তিত হয় ভিন্ন রূপে।
-o-
ইগোর কালান্তর
ভবিষ্যৎ–স্বপ্নের পোড়ো বাড়ি রাত্রিময় সংশয়ে ভরা।
তাই সমকাল ও স্মৃতি নিয়ে
টিকে থাকে আত্মাভিমান।
তবু স্বপ্নলোকে নিজেকে দেখি যদিও বিরাট,
তিরিশ বছর পর তুচ্ছ হয়ে যাবে আমার বর্তমান কাল
তথা ভবিষ্যতের স্মৃতি
যদি পরিণত হই বিরাটে;
বর্তমানে যেমন তুচ্ছ অতীত
চেতনার করোটিতে।
—- আমারই উপস্থিত সত্তা পূর্বেকার সত্তাকে উপহাস করে।
-o-
জড় ও মনোলোক
জড় সব বস্তু হয় দুর্দিনের রূপক ইশারা।
নিদ্রাহীন রাত্রিতে বালিশে বালিশে মেশে
প্রেমের ক্লান্ত ফসফরাস।
রাতের বাতাসে নিরুদ্দেশ ঠিকানা হতে
ছত্রাক জমে ওঠে নষ্ট রুটির পিঠে।
-o-
লাইট–হাউস্
বিস্তীর্ণ দরিয়ার মাঝখানে জনশূন্য দ্বীপে
নিঃসঙ্গ লাইট–হাউস্ সমুদ্রের জলের উপরে
রশ্মি নিক্ষেপ করে।
তলদেশের অগুনতি মাছ
আলোকে লক্ষ্য করে হলুদ ইচ্ছের খোঁজে
শূন্য গন্তব্যে সাঁতরে রওয়ানা হয়।
-o-
ঘুম
সারাদিন বাগানের শূন্য দোলনায়
দোল খাই আমি আর
দোল খায় আমার
নিজস্ব হৃদয়।
ক’মুহূর্ত পর নামে জীবনের পড়ন্ত বিকেল,
সে’ মুহূর্তে খেই হয় –
এতোক্ষণ দুলেছি এক শূন্য দোলনায়।
-o-
সরীসৃপ
মরা শ্মশানের বুকে অথর্ব সন্ধ্যায়
কালপেঁচা, শকুনির ডাক থেমে যায়।
অশ্বত্থের ডালে নাচে মলিন জ্যোৎস্না।
ধোঁয়া ফুঁড়ে ওঠে ধীরে ক্ষুব্ধ কুয়াশার।
ঝলসে ওঠে আসমানে মৃত্যু–তারকা;
যেন হিংস্র তলোয়ার। আঁধারে ডুবে
যেন সন্ত্রস্ত কালপুরুষ। দেবদারু বনে
সারা রাত বয়ে চলে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।
নিঃশ্বাসের শব্দে জাগে ঘুমন্ত ময়ূর।
মায়া–হরিণীর মন ভীরু, পলাতকা।
বিষাক্ত সত্তার শোকে ক্রন্দসী কান্নায়
ভাসায় নিজ দেহ। বিষাক্ত নদী বয়,
ভয়ার্ত উষ্ণ বাতাস। প্রেতাকীর্ণ রাতে
সারাক্ষণ শোনা যায় বিষাক্ত নিঃশ্বাস—-।
-o-
কাক
পূর্ণিমা–রাতের ছায়া–আলোকের লীলা
নির্বাক লাশের ছবি নিয়ে খেলা করে।
রাস্তার এপাশে–ওপাশে ছড়ানো লাশ
মর্মর মূর্তির মতো শুয়ে শুয়ে থেকে
ভয়াল দুর্ভিক্ষ–দৃশ্য দেখে পরিহাসে।
নর্দমায় নিক্ষিপ্ত মৃত্যু–প্রলাপ। মরা
শবের ঘোলাটে চোখ স্বপ্নগর্তে ঢুকে
তারালোকী স্বপ্ন দেখে পচনের আগে।
লাশের গায়ে পা পড়ে চঞ্চল কাকের।
মৃতের মাংস আঁচড়ায় ক্ষণকাল
আর কালান্তরে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায় কাকে।
কাকের ব্যস্ত আঁচড় ব্যবচ্ছেদ করে
আর তুলি ধরে নগ্ন পৃথিবীর বুকে:
আঁকে ঝাপসা স্বপ্নমেশা পূর্ণিমা–রাত।
-o-
স্টেজ
নাট্যমঞ্চে নায়কেরে একচ্ছত্ররূপে
চোখে ঠেকে আকর্ষণহীন।
তাই স্টেজে চলে রক্তপাত ও চরিত্রের উত্থান–পতন।
নতুবা রীতিবিরুদ্ধ অঙ্কের উপস্থাপন
তীব্র রোষানলে পড়ে নির্দেশক নাট্যশাসকের।
উপরন্তু কেন্দ্রীয় নট
নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠ চেতনায় বীজ পোঁতে গাঢ় অসন্তোষের।
-o-
ইলেক্ট্রিক ফ্যান
ছাদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলা
ইলেক্ট্রিক সিলিং ফ্যান চক্রাকারে রূপ নেয়
নাগরিক স্বপ্ন–প্রতীকে।
হাওয়ায় ভেসে আসা ধুলোর আস্তরণ
স্বয়ংক্রিয় ধাতব পাখার
তিন ডানায় সংস্থাপিত হয়।
শূন্য সুদর্শন চক্র নোনাধরা দেয়ালের ঘরে
অন্ধকারে একাকিত্বে পড়ে।
রেগুলেটার–বোর্ড প্রাকৃত বর্জ্য নিয়ে পেইন্টবোর্ড হয়।
—স্তরে স্তরে ময়লা জমে স্বপ্নের ঘুরন্ত পাখায়—
-o-
তেরো
ঘরের মধ্যে কালো বেড়ালের চোখ
অন্ধকারে পড়েছে জনশূন্যতায়।
কী একটা বিশ্রী পাখির কণ্ঠস্বর
আজ ঘোর অমাবস্যায় শোনা গেল!
বাড়িটা রোদেলা দিনেও থমথমে।
তেরোটি বেগুনি রশ্মি ছাদের পৃষ্ঠে
সারা রাত প্রেতের মতো খেলে যায়।
বারান্দায় চাবুকের অস্পষ্ট স্বর
শোনা যায়, নর্তকীর নূপুর বাজে
জীর্ণ সভায়; এটি ভাঙা পোড়ো বাড়ি;
মৃত পূর্বপুরুষের কালো রাজত্ব।
প্রেতের পদধ্বনি ধেয়ে আসে কানে
আমার; শূন্য গর্ভ, শুধু মরা লাশ।
-o-
পামিস্ট্রির পুনর্বিচার
অজ্ঞাত নির্দেশে হিম বায়ু ভেসে আসে পরবাস থেকে।
আকাশ ধোঁয়াটে হয় রাত্রিময় ফিনফিনে কুয়াশায়।
প্রতিকূল পরিস্থিতি জন্ম নেয় বিস্তীর্ণ স্তেপের ঘাসে,
ভ্যাকুয়াম বদ্ধ ঘরে, পাউরুটির পৃষ্ঠায়, জলস্রোতে।
বহিরাগত ‘লু’ হাওয়া উষ্ণ করে নকশা–দীর্ণ হাত।
শিল্পময় দু’হাতের চামড়ার জমি হয় শুষ্ক–চৌচির।
ত্বকের স্খলন ঘটে নিরাকার–নিরুপায় অদৃষ্টের
মাদকাসক্ত জ্যোৎস্না আর গাঢ় কড়া রোদ্দুরে আভায়।
প্রসাধনী পণ্যদ্রব্য উত্তরণ আনে জীর্ণ চামড়ায়।
তবু নিয়তির দৃষ্টি থাকে সংস্কার–শূন্য সনাতন।
আড়ষ্ট আকাল আসে হস্তত্বকে অবচেতনায়।
জ্বর, যক্ষ্মা, চর্মরোগ, কুষ্ঠরোগ ঘাঁটি গাড়ে জরাগ্রস্ত হাতে।
স্বপ্নেরা ঊর্ধ্বে উঠে তারালোকে ঘুরপাক খায়।
তবু হস্তরেখা চিরকাল থেকে যায় মৃত্যুময় পেইন্টবোর্ড।
-o-
সিঁড়ি
সিঁড়ির ধাপে ধাপে
প্রকট ধ্বনিতে বাজে
অর্কেস্ট্রা, বুটের কোরাস।
সম্মিলিত ঋজু পদক্ষেপ
শূন্যগর্ভ লহরী তোলে আর
স্বপ্ন দেখে খোদ উপর তলার।
সারাটা সিঁড়িতে চলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
হীরক–খন্ড, প্রেম ও প্রবল ক্ষুধার।
সিঁড়িতে বিছানো থাকে রক্তভেজা ফরাশ;
লালাসক্ত লোভেরই ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে আঁটা।
আবার সাজানো থাকে লাল বর্ণে আঁকা আল্পনা;
স্বপ্নে ডোবা যা উপর তলার সোনালী কল্পনায়।
সহযাত্রী আরোহীর ভিড় বাড়ে, বেড়ে চলে সংঘর্ষ
অনন্ত রাতের; অভীপ্সার নীল সিঁড়ি ভেঙে পড়ে যায়।
-o-
টুইন টাওয়ার
সময়ের অতিক্রম্যতায়
অস্তিত্বের উচ্চ স্তম্ভ পতনের প্রতীক্ষায়
গুনে চলে কাল।
প্রতি মুহূর্তে তার ও ধ্বংসের
গভীর মৈত্রী।
-o-
দেয়াল
যুদ্ধ–যাত্রায়
পথের বিস্তীর্ণ ধুলো উড়িয়ে চলে অভিন্ন রথে
অভিন্ন গন্তব্যের পথে
সম্রাট ও সারথি।
তবু প্রাসাদ–কক্ষের গাঢ় অন্ধকারে
দু’জন অবস্থিত দেয়ালের দু’পাশে;
অনুষঙ্গবিহীন।
-o-
পিঞ্জর
দিগন্ত সীমিত চোখে, সেই পিঁজরায়
পাখির মনের লাশ। পালাবার ইচ্ছায়
পাখি শুধু অবিশ্রাম ডানা ঝাপটায়
আর সব রোষ ঝারে পিঞ্জরের শলায়।
ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে জ্বলে ওঠে পাখির শরীর,
ছিঁড়ে ছিঁড়ে বেরোয় যতো অস্থির পালক
তার নম্র দেহের। স্বপ্ন দেয় ঝলক
উন্মুক্ত আকাশের ক্রোড়ে উড়ে বেড়াবার।
পিঞ্জরের পরিধিটি যেন বেড়ে যায়
প্রবল উত্তাপে। তার দৃষ্টির শক্তি ক্রমে
ঝাপসা হয়ে আসে, সুস্পষ্ট হয় দ্রুমে
ফেরার কামনা। তবু সে’ স্বপ্ন অসহায়
কল্পনাই রয়ে যাবে, হবে না বাস্তবে;
ঝাপটানো ডানা শেষে রূপ নেবে কাবাবে।
-o-
মন্দির
ধূপের ধূসর ধোঁয়ার আড়ালে পড়ে থাকে
মন্দিরের প্রতিমার মুখ।
মন্দির–বেদীতে রক্ত জমে ওঠে খুনের
বলিদানের নিঃশব্দ রাতে।
উন্মত্ত ঘূর্ণিঝড়ে
ধসে পড়ে মন্দিরের ভিত;
কাটা মুন্ডু সারা রাত্রি ধরে
হোলি খেলে পৃথিবীর মরা ঘাস–দূর্বার সাথে।
তবু ঢং ঢং ঘন্টা বাজে মৃত্যুপ্রলাপের মতো
আজও এই ভাঙা মন্দিরে।
আর অদৃশ্য পর্দা তার
আজও কাঁপে আদিম হাওয়ায়।
-o-
সুলভ শ্রেণীর কামরা
রেলগাড়ির এক একটা কামরায়
ঘুরে ফিরি পরীর সন্ধানে। খুঁজি আর
খুঁজি দু’চোখের নীল নারী। লিস্ট থেকে
বাদ থাকে সুলভ কম্পার্টমেন্ট, শুধু
খুঁজে ফিরি প্রথম শ্রেণীর কামরায়।
অবহেলিত, অবনত সুলভ শ্রেণী
আমার চোখে দেখা দেয় অস্পৃশ্য হয়ে
(দামী হুইস্কির মাঝে সস্তা দেশি মদ)।
হঠাৎ একবার অবিদিতার খোঁজে
যখন ট্রেনের সুলভ কক্ষে ঢুকেছি,
প্রাপণীয়া (অথচ পরিত্যাজ্যা) ভিক্ষুক
নারীর – প্রেম দূরে থাক, তার ভিক্ষার
প্রার্থনা ছুড়ে ফেলে ছিনালির লিপ্সায়
চোখ নিবদ্ধ রাখি স্বপ্ন–কন্যার দিকে।
-o-
দুধের মাছি
সাদা দুধ বেয়ে পড়ে টেবিলের ’পরে
পূর্ণ পেয়ালা হতে। আঁঠালো টেবিলের
পিঠে মাছি উড়ে এসে শ্লেষ্মা ফেলে আর
দুধের বাটির পাশে ভিড় করে বসে।
ক্ষুব্ধ তৃষ্ণায় তার সাত রাতের ঘুম
কবরস্ত হয়। জেগে থাকে স্বপ্ন তার
তিক্ত রসনায়। মাছিরা আকাশে উঠে,
সাদা স্বপ্ন নীল হয়ে শূন্যে লীন হয়।
পাত্রের মুখে ঢাকনা পড়ে কালান্তরে।
প্রবঞ্চিত অসহায় মাছির কাফেলা
দুধের স্বাদ খোঁজে দুগ্ধ–পাত্রের গায়ে
জিভ চেটে চেটে। পান করে ঘন্টা ঘন্টা
ছোঁয়াশূন্য তরলের নীল স্বপ্ন আর
স্বপ্ন দেখে প্রতি রাতে – সাদা ও সফেন।
-o-
নয়–ছয়
শরীরের রক্ত হলুদ
আর ত্বক লাল,
নাকি তার ত্বক সবুজ
আর রক্ত নীল?
যেকোনো নামেরই আগে
যেকোনো পদবী;
পদ্যের অসতর্ক চোখে
পিঁচুটি পড়েছে।
মস্তিষ্ক–গর্ভে গোলমাল
শুরু হলো মোর;
কথা বলতে আটকায়
জিভ। পাঁচ ডিগ্রী
জ্বরে প্রলাপ বকছি। অ্যাঁ!
প্রলাপ বকছি?
-o-
আমার আদালত
আদালত ঘোষণা করে সত্তা মোর স্ব বৃত্ত–সীমায়।
টেবিলের পিঠে পিঠে হাতুড়ি ঘোষণা করে রায়।
আসামী স্বয়ং আমি, সাক্ষ্য দেয় বিপক্ষে আমার
জনশূন্য বেঞ্চ। তদ্রূপ, অসংখ্য শূন্য আসন
বিচার–দর্শক। জেরা করে চারপাশের দেয়াল।
এবং অতঃপর প্রতি রাতে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলায়।
-o-
চেতনালোক
১৪. কিনারে কিনারে করে আলোর সন্ধান।
১৩. স্ফুলিঙ্গ ঊর্ধ্বে উঠে বিনিদ্র আকাশের
১২. রৌদ্র–দগ্ধ মন ভরে কুটিল বাতাসে।
১১. মস্তিষ্কে ঘাম ফেলে জটিল শাস্ত্র সব,
১০. চিড় জাগে মস্তিষ্কে ভ্যাপসা বাতাসে।
৯. রোদ্দুরের শস্য জন্মে আলোশূন্য মনে,
৮. শব্দের স্ফুলিঙ্গ ওঠে বালির সৈকতে।
৭. বুদবুদ উঠে মগ্ন ধ্যানের সমুদ্রে;
৬. মুক্তি চায় আঁটো–সাঁটো দর্শনের থিম।
৫. জড় মস্তিষ্ক–ভিতে রন্ধ্র খোঁজে হৃদয়;
৪. অতিক্রান্ত হলে কাল অতল ধ্যানের।
৩. সংস্কার কামনা করে চিন্তার বীজ
২. স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ফের লোপ পায়।
১. অস্পষ্ট আড়ষ্ট চিন্তা ভেসে ওঠে মনে,
রচনাকাল: ১৯৯৩–৯৫
সর্বশেষ পরিমার্জনা: অক্টোবার ২০০৯
Printed Version:
Comments are closed