সমুদ্র-মন্থন
অপ্রতিম রাজীব

ভূমিকা
প্রজাপতি দক্ষ তাঁর দুই মেয়ে দিতি ও অদিতিকে কশ্যপ মুনির সাথে বিয়ে দেন। দিতির গর্ভজাত ছেলেরা দৈত্য আর অদিতির পুত্ররা দেবতা নামে পরিচিত হন। সৎভাই দেবতা ও দৈত্যদের মধ্যে শুরু থেকেই ঘোর শত্রুতা। এদের মধ্যে যুদ্ধ-সংঘাত চিরদিনের। যুদ্ধে নিহত দৈত্যদেরকে তাদের গুরু শুক্রাচার্য সঞ্জীবনী মন্ত্রবলে পুনর্জীবিত করতেন। দেবতারা শুরুতে এমন্ত্র জানতেন না। দেবগুরু বৃহস্পতির ছেলে কচ শুক্রাচার্য ও তাঁর মেয়ে দেবযানীর শিষ্য হয়ে ঘটনাচক্রে সেই মন্ত্র শিখে নেন। ফলে মৃত দেবতারাও পুনর্জীবিত হতে থাকলেন। কিন্তু এতেও তৃপ্ত না হয়ে দেবতারা চাইলেন চিরদিনের জন্য অমর হতে। ব্রহ্মার পরামর্শে দেবতারা ক্ষীরোদ সাগর মন্থন করে অমৃত লাভের পরিকল্পনা করলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের প্রস্তাবে দানবরা দৈত্যরাজ বলির নেতৃত্বে একাজে দেবতাদের সাহায্য করতে রাজি হলেন। এঅমৃত পান করে দেব ও দানবরা অমর হবেন। পরিকল্পনামাফিক নাগরাজ বাসুকিকে মন্থন-রজ্জু করে এবং মন্দর নামের পর্বতকে মন্থন-দন্ড করে নিয়ে একে কচ্ছপরাজের উপর বসিয়ে মন্থন-কাজ শুরু করলেন দেবতা ও দানবরা। দেবতারা বাসুকির লেজের দিকটা ধরলেন আর দৈত্যরা এর মুখের দিক ধরলেন। এভাবে হাজার বছর ধরে মন্থন করার পর সমুদ্র হতে দুধ ও ঘৃত উঠে আসে। উৎসাহিত দেব-দানবরা মন্থন-কার্য চালিয়ে গেলে সমুদ্র থেকে একে একে উত্থিত হয় উর্বশী ও অন্য সব অপ্সরা, ধন-দেবী লক্ষ্মী, সমুদ্র-কন্যা সুরাদেবী, চন্দ্র ও পারিজাত নামের কল্পবৃক্ষ। অপ্সরারা স্বর্গের নৃত্যশিল্পী ও সকলের সাধারণ স্ত্রীরূপে গৃহীত হন। লক্ষ্মীকে আদিদেব নারায়ণ বিয়ে করেন। সুরাকে দানবরা প্রত্যাখ্যান করে অসুর আর দেবতারা গ্রহণ করে সুর উপাধি পান। চন্দ্রও দেবতাদের কাতারে ভিড়ে যান। পারিজাত বৃক্ষ ইন্দ্র লাভ করেন। এছাড়াও সমুদ্র হতে উঠে আসে কৌস্তুভ মণি, ঐরাবত হাতি, উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়া, ছাতা ও কুন্ডল। এসমস্ত ধন-সম্পদ দেবতারাই অধিকার করেন। সুরাসুরেরা অমৃতের আশায় মন্থন-কার্য চালিয়ে গেলে সমুদ্র থেকে এবার উঠে আসলো ভয়াবহ কালকূট বিষ। এবিষের প্রভাবে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস হতে চললো। তখন মহাদেব শিব সেই বিষ পান করে সৃষ্টিরক্ষা করলেন। বিষের তীব্রতায় শিবের কণ্ঠ নীল রঙের হয়ে যাওয়ায় তাঁর অন্য নাম নীলকণ্ঠ। তারপর দীর্ঘকাল সমুদ্র-মন্থনের পর চূড়ান্ত পুরস্কার অমৃত-ভান্ড হাতে চিকিৎসা-দেব ধন্বন্তরি উঠে আসলেন। অমৃতের অধিকার নিয়ে দেবতা ও দানবদের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধ চলাকালে নারায়ণ মোহিনী নারীর রূপ ধারণ করে দৈত্যদেরকে প্রতারিত করে তাদের কাছ থেকে অমৃত-ভান্ড নিয়ে নেন। দেবতারা অমৃত পান করে অমর হলেন। রাহু নামে এক দানব ছদ্মবেশ ধারণ করে দেবতাদের সাথে অমৃত পান করে। চন্দ্র ও সূর্য তাকে চিনতে পেরে নারায়ণকে বলামাত্র তিনি সুদর্শন চক্র দিয়ে রাহুর শিরশ্ছেদ করলেন। কিন্তু ততোক্ষণে অমৃত তার কণ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ায় তার শির অমরত্ব লাভ করলো। সেই থেকে ক্রুদ্ধ রাহু চাঁদ ও সূর্যকে পর্যায়ক্রমে গিলে খায়। কিন্তু সূর্য-চাঁদ তার কাটা গলা দিয়ে বার বার বেরিয়ে আসে। রাহুর সূর্যগ্রাসের সময় সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রাসের সময় চন্দ্রগ্রহণ হয়। এরপর দেবতা ও দানবদের যুদ্ধ প্রলয়ঙ্করী রূপ ধারণ করলো। অসংখ্য দানবের রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ হয় এবং দেবতারা ত্রিলোক অর্থাৎ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের অধীশ্বর হন।
১.
দেবসভা
অতলান্ত জল থেকে অমৃতের স্বপ্নফেনা উঠে
বুদবুদের মতো। কৈলাশোপরে উঠে স্বপ্নবাষ্প
বৃষ্টিরূপে প্রাসাদের অলিন্দে অলিন্দে ঝরে আর
সোমরসে মত্ত দেবতার কানে সে’ শব্দ যেন
স্বর্গবেশ্যার রাতের শীৎকার। ক্লিন্ন অপ্সরীর
পায়ের নূপুরধ্বনি ক্রমে ক্রমে ধেয়ে আসে কানে।
মরা অপ্সরীর আত্মা করোটিতে জুড়ে দেয় নাচ।
গাঁজা ও সোমের আচ্ছন্নতায়
সাগরতলের নূন চুষে খায় কল্পনা –
একান্ত বয়োঃবৃদ্ধ, নীল।
নোনা গন্ধ স্বপ্ন হয়ে মর্ত্যে ঘুরে; পাতালের দানবরাজ্যে ঘুরে
ঘুমের কাল বাড়ায়; বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলে বাতাসে।
ব্রক্ষ্মা (সোমরস পান করে)॥ হে অনার্য কোম দেবতা,
তারাপুঞ্জ অনুপস্থিত, স্বপ্নালু রাতের আলো তবু মদালস।
ফাল্গুনিক এ’ তিমির পরিণত এই চোখে লাল তন্দ্রায়।
নেশার্দ্র মদ্যের কলস
নীল বুদবুদ বাষ্প ছাড়ে স্ব মুখে। শীৎকারের প্রতিশব্দ
যেন সে’ আওয়াজ। মদ্যধারক পাত্রের সুনিপুণ সূক্ষ্ম কারুকাজ
কার্বন কাগজ ফেলে অনুচিত্র তৈরি করে
করোটির স্নায়ুকোষে; সর্পিনী ফণা তোলে
আরণ্যক নাচ নাচে; সাপুড়ের আদিম সিম্ফনি বাজে
এপ্রাসাদের প্রতিরূপ আমার করোটিতে।
শিব ॥ সঠিক! সঠিক! কিন্তু কিরণ-সম্ভোগ থেকে
কারনই শ্রেয়ঃ। কারণ সে মদ
শূকরের মলকেও দৃষ্টিতে অপরূপ করে।
বিস্রস্ত রাত্রির নীল অন্ধকার,
উগ্র সাপের নাচ, উন্মত্ত স্রোতের শব্দ,
কালো সারমেয়ের চোখ, প্রেতার্ত তারকা-কিরণ –
এসবের সমষ্টি তরল মিশ্রণ হয়ে
পরিপাকতন্ত্রে গিয়ে শুরু করে ক্লেদাক্ত পচন।
পরিণামে তরলতর বাস্তবিক মোহ
ধাঁধায় বিনষ্ট হয়। জনাকীর্ণ পার্বত্যপ্রদেশ
তান্ডব-নৃত্যের তালে দ্বিধাগ্রস্ত। ঘুম
নিরাপদ, ক্লান্তিহীনতায় মূক।
ব্রক্ষ্মা ॥ স্বপ্ন, সন্ধ্যা, তিমিরের বিস্রস্ত প্রলাপ,
গহন মদ্যের তলে ঘুমের ঐশ্বর্য খোঁজা আর
জন্ডিস রোগে ভোগে হলুদ প্রস্রাব ত্যাগ
এজীবনে নিত্য ঘটনা। কৌমার্য কাবার।
তবু ধাবমান মৃত্যুর নিক্কণ অসহ্য, ভার
মস্তিষ্কের করোটিতে। এ’ আত্মরতি হতে
মুক্তি অন্বিষ্ট তাই সর্ব দেবতার।
একান্ত জিঘাংসার রাত
অতিক্রান্ত; হিংস্র নপুংসক অভিশাপ
প্রেতাকীর্ণ শ্মশানে ফেরে। হিংস্র দাবানল
স্প্রিংবাক, বাঘসহ বনকে পোড়ায়।
নারায়ণ ॥ উপরন্তু দানবীয় স্বৈর প্রতাপ
বিক্ষিপ্ত করে চিত্ত, স্বপ্ন, ঘুম, রাত।
দৈত্যাগ্রাসন
সন্দিগ্ধ মনের ’পরে ফেলে গুরুভার।
শক্তিসাম্য দানবের অনুকূলে আজ;
আঁধার ক্রমধাবমান, মুমূর্ষু আলোক।
অসংবদ্ধ ভীতির বিস্তার
প্লেগ রোগের ন্যায়। সংক্রামক সন্ত্রাস
রাত-ঘুম সাগরে আনে ঢেউ,
প্লাবিত করে সমভূমি, আকাশে আনে ঝড়।
অপয়া কালো বেড়ালের চোখ
রাঙায় সত্তার গুহা, দানবের করাল গ্রাস
গিলে খায় আলোর প্লাবন।
(যম ও নারদ ঢুকলেন)
যম ॥ এ’ সমুদ্র জীবনের;
উত্তাল, স্রোতক্ষুব্ধ, অশান্ত, সফেন,
বাক্যহীন বোবা কষ্টে নীল, স্পন্দিত, ব্যাকুল,
ঢেউয়ে ক্লান্ত, অধীর।
মৃত যোদ্ধার জ্যাবজ্যাবে রক্তের ছাপ
ধুয়ে নেয় উন্মত্ত ঢেউ।
দ্বিধাক্রান্ত তারা-দেবতার
আলোয় নগ্ন রাত অনিঃশেষ ঐকতানে মেতে
তামাগ্নি-সন্দিগ্ধ চিত্তে ফসফরাস বহায় রক্তে
অসংখ্য মাছের। দাবাগ্নি-সদৃশ
উত্তাল রণরোল ওঠে,
ক্লেদাক্ত সত্তার পিছে ক্রমধাবমান
স্তম্ভিত বিষাদে নম্র দাঁড়কাক-কোকিলের ভিড়ে
হারায় আবার। স্বপ্ন ভেঙে দুমড়ে যায়,
পলকে পলকে ক্লান্তি
গ্রাস করে জীবনের রোল।
নিদারুণ রক্তিম ক্ষোভ গাঢ় তপ্ত সূর্যালোকে মুছে
সত্তার দু’চোখে লেপ্টে।
ঘুমহীনতার ক্লান্তি রাত গ’ড়ে দুপুরের রোদে
আগ্নেয় পাহাড়ে পিষ্ট হয়।
অনৈকতানিক শব্দে হাহাকার-সংমিশ্রিত লোকে
কাঁকড়া কামড়ে দেয় মৃগেলের লেজ।
তারপর নিরাপদ তন্দ্রায় আচ্ছন্ন সূর্যের রেশ
অনন্ত রাতের জন্যে রেখে যায় ঘুম।
পাপবিদ্ধ যন্ত্রণার মর্মর মূর্তি গড়ে
প্রার্থনা-সঙ্গীত গায় অজানা পরিত্রাতার।
নারদ ॥ অবিমিশ্র আনন্দের গুরুভার
মেটায় স্বপ্নের তৃষা,
অপরিমিত আলোকের রাশি
সত্তার শূন্য গর্ভে পূর্ণ করে আঁধারের ক্ষোভ।
অনিন্দিত ক্ষোভ-দুঃখ-শোক
জীবনের ক্লান্তিকে মাল্যদান করে।
তদুপরি কালিমার ব্রাশপেইন্ট বৃদ্ধি করে
বিকৃত আনন্দের পুঁজি।
যম ॥ প্রেম, স্বপ্ন, সম্পদ ও মৃত্যু হিম
নির্লিপ্ত সাগরের গহীন গভীরে
লেপ্টে আছে ক্লিন্ন, বুভুক্ষু, জরাগ্রস্ত অভিজ্ঞানের মতো।
তৃষ্ণাঙ্কর অশরীরী প্রেতিনীর উপাখ্যান,
অন্ধকার নৈঃশব্দের নিস্পৃহ বিলাপ,
রজনীগন্ধার সুবাসিত আত্মদান,
ইন্দ্রিয়সুখকামী কামুকের মাতালতা,
ব্যাঙ্গমার পলাতক ডাক,
আকাশের ক্রমধাবমান তারা
স্বপ্ন দেখে সমুদ্রের – সাদা ও সফেন।
অনিঃশেষ ঐকতানে সিম্ফনি সৃষ্টি করে
কাজ করে সকল শ্রমিক।
জড়, কবন্ধ, নর্মাচারী, প্রেতাত্মা, পাষন্ডের দল,
দুঃস্বপ্নে স্মৃতিভ্রষ্ট, যুক্তিভ্রষ্ট, নীতিভ্রষ্ট নারী,
ক্রীড়ক, তিমিরমগ্ন, নারকীয় স্বৈরিনীর প্রেমিক,
জীবনের ক্লেদাক্ত, রক্তাক্ত, পঙ্কমগ্ন সাইরেনের সুর
অমরতার খোঁজে মগ্ন, লীন।
(ইন্দ্র ঢুকলেন)
ইন্দ্র ॥ ঘুমাই না কতো দিন, অতন্দ্রিত স্বপ্নের তৃষা
আমাকে তাড়িত করে, ঘুমহীনতার ক্লান্তি
দু’চোখে ছড়ায় কালি, অন্তরের গ্রহ
শত শত অগ্নিগিরির মুখে দেশলাইয়ের আগুন জ্বালায়।
ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে নাসাপথ দিয়ে;
সাইনাস-যন্ত্রণা, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, আকাশভেদী আর্তনাদে পরিকীর্ণ রাত
তারাগুচ্ছ নিয়ে আঁকে কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমন্ডল।
উদয়াস্ত সংবৃতা লাল-নীল-রূপালী-হলুদ
বিচিত্র স্বপ্নব্যাধির প্রদীপকে উস্কে দেয়,
নীল সুখকামনায় জ্বলে মরে দীপ্ত স্বপ্ন, প্রদীপ্ত আরতি।
এরপর
বসন্ত বিদায় নেয়, নীলবর্ণ চোখে পড়ে ছানি;
প্রিয় খাদ্য বিস্বাদু, প্রেম বিলুপ্ত রোমাঞ্চ মনের।
অভিশপ্ত নীল মাছি পাক খায় শূন্য থেকে শূন্যের কন্দরে।
পাক খায় স্বপ্ন, রাত্রি, মদ।
পাক খায় মৃত্যু, মৌন ঘুম।
অপ্রতিম কল্পনার সমুদ্রে সমাধি পায় প্রেম।
ঠান্ডা মৃত্যু স্থায়ী ঠিকানা গাড়ে কাঠের কফিনে।
নারদ ॥ হা ঈশ্বর!
ইন্দ্র ॥ সে আবার কে?
নারদ ॥ সীমিত সত্তার ’পরে প্রভুত্বকারী
চূড়ান্ত ও অপরিবর্তমান অন্ধকার সত্তা,
সব ক্ষুদ্র, সীমিত কারাবাসী সত্তার
চিরন্তন আদিগন্তবিস্তৃত সারাংশ
নিজেকে যা জ্যোতিষ্মান করে
বদ্ধ কারাকক্ষের ভেতর।
ইন্দ্র ॥ সে’ নৈর্ব্যক্তিক সত্তার কাছে
আকুলতা প্রকাশের হেতু?
নারদ ॥ প্রজ্ঞা বিনষ্টি ও প্রতিকূল অদৃষ্টের দিনে
সে’ই আশ্রয়, পালাবার সুড়ঙ্গপথ।
পলায়নই যাত্রা এজীবনের;
বেড়ালতাড়িত ইঁদুরের প্রস্থানের মতো।
ইন্দ্র ॥ আপনিও কি তবে সেই –
নারদ ॥ পলায়নবাদী।
পঙ্কমগ্ন নর্মাচারে কাদালিপ্ত-আবিষ্ট থেকে
মতিভ্রষ্ট-বিস্মৃত-আত্মহারা নিরাপদ ঘুমে
অন্বিষ্ট খুঁজি। অনন্ত তমিস্রার প্রেম
ঘুলঘুলি-রূপ পায় মগজের কুঠরিতে,
আয়নায় আত্মমূর্তি হয়ে ওঠে অতিকায় দানব।
মগ্নকণ্ঠ কলসের দড়ি ধরে স্বহত্যা করে
বিম্বিত ইন্দ্রধনু। মুহুর্মুহু রক্তপাত যেমন
স্টেজের বুকে অভিনেতাদের করে তোলে
নায়ক ও খলাভিনেতা, উপচ্ছায়া প্রেতাত্মার উপস্থিতি
ঘোর রাত্রিকে করে তমোময় অসমীকরণ।
যম ॥ তবুও উন্মত্ত, স্মৃতিভ্রষ্ট, নাস্তিগত শোক
অনিরুদ্ধ প্রেতাত্মার সৎকার-লিপ্সায়
উত্তরঙ্গ সমুদ্র খোঁজে পৃথিবীর বুকে;
নীল স্বপ্নের আবেষ্টনে রক্তিম রক্তপাত,
ঈর্ষা, ঘৃণা, দ্বেষ, লিপ্সাদি রিপুর
দাসত্বে দীক্ষিত হয়। অনুর্বরা পাতালের অন্ধকারে
মৃত্যুত্তীর্ণ জীবনের স্বপ্ন দেখে, উচ্চকণ্ঠ কলরবে
পাপিষ্ঠ, মূঢ়দের বহুমূল্য সঞ্চয়ের
তল্পিতল্পা বিদায়ে উচ্চকিত হয়।
ঘুমঘোরে সাপের বিষছোবল – নিভন্ত অগ্নির শিখা
পঞ্চ প্রপঞ্চ আত্মগত করবার লোভে
আত্মবিনাশের সরল শপথে হয় তৎপর।
কৃত্রিম বিদ্বেষের নিপীড়ন
মস্তিষ্কে জ্বালায় অগ্নি, সত্তার নৈতিক বোধের
ভূলুন্ঠিত বেহাল দেহে অস্ত্রোপচার শেষে
দাবানলে পোড়া বনে কবরস্ত করে।
প্রাঞ্জলতা নিরস্তিত্ব, অসম্ভব স্বপ্নের
অন্বিষ্ট আজ। যুক্তিহীন রূপকল্পে
অধরা স্বপ্নিল অমর্ত্যলোক। অতএব যুক্তিবাদ
স্বপ্ন-ঘুম বেষ্টিত বোধের বিপরীত।
সুতরাং যুক্তির প্রকোষ্ঠ নির্মাণেও শেষাবধি
বোধের বিরতি। বোধ ও যুক্তি মিলে
তৈরি করে আত্মদ্বন্দ্ব-আক্রান্ত কলা।
শয্যা-তোশকে শুয়ে স্বপ্ন দেখে আকাশের
বালিয়াড়ি মন আর মাতাল শরীর।
নষ্ট প্রেম, মৃত স্বপ্ন ঘাম-ভেজা বিছানায়
বেহুঁশ, বিলীন হয়ে গড়াগড়ি খায়।
বিছানা ও নীল শূন্যে পৃথক পৃথক রাত্রি নামে।
তপ্ত ধোঁয়াচ্ছন্ন উনুনের হাড়ি থেকে
মশলা-মাখা রোস্টের বিকৃত গন্ধ উঠে
নরখাদক উদ্ভিদের নাসাপথে বেরিকেড গড়ে।
২.
ইন্দ্র
ঘুমাই না কতো রাত, বেঘোর ঘুমের কাম
নেশাকর তামাকের মতো আমাকে তাড়ায়।
ঘুমের ডিমটি ভেঙে গেলে তার ভেতর থেকে
যে স্বপ্নের কুসুমটি বের হয়,
তাকে বরফের আগুনে পোচ করে খাওয়ার সাধ অনেক দিনের।
কিন্তু তা কীভাবে হবে? যুদ্ধেই বার বার হারি।
রথের চাকার শব্দ শুনলেই এক বেগুনী বসন্ত-রাতের কথা মনে আসে,
যে রাতে ছিল ক্রিসমাস গাছের মতো আলস্য, পাউরুটির রঙের মতো দুঃখ
আর ৯৮৭৬ ঘন্টা জুড়ে নক্ষত্র ভাজার গল্প।
পাকে ডোবা নর্মাচারে শরীরকে ময়লা করে
আত্মহারা ভিমরতির ঘোড়াঘুমে অন্বিষ্ট খুঁজি।
অনিবার্য একটানা ঘুম
কমলা রঙের বন্যায় ভেসে যায় আকাশ
শূন্য দিগন্তে সাত রঙের ধনুক
যেখানে ফল পড়ারও শব্দ নেই
সেরকম এক নিবিড় জঙ্গল
স্বপ্নের ঘুলঘুলি
স্বপ্নের হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি
বেঘোর বেহিসেবি ঘুম
জ্যোৎস্নার তাপে মুছে যায় শিশিরের কণা
দুঃস্বপ্নের স্মৃতি মুখস্থে আবিষ্ট সত্তার চোখ
নির্বিকার ঘুম
স্বপ্নের ফুলক্ষেতে চামেলি খেলা করে
রঙীন বাতাসে ফুলের চীৎকার
রঙধনুর আত্মখুন
স্বপ্নহীন ঘুম
শূন্য মাঠ তেপান্তর
আগুনে দগ্ধ ঘাস
নির্লিপ্ত ঘুম
হাই তুললে তার ভেতর থেকে যে দ্যুতি বেরোয়
তা দিয়ে সাম্রাজ্যের স্বপ্ন নির্মাণ করি
যে স্বপ্ন থাকে সবুজ ডিমের ভেতর
আর সেদ্ধ ঘাসের গন্ধ থাকে তার মধ্যে।
আর এখানে আমার ভয় করে, কারণ
এখানে কোনো ভূত নেই।
দানবের জয়ডঙ্কা শুনে খাঁচাবন্দী ধনেশের লম্বা হলুদ ঠোঁটের
ক্লান্ত ঠোকরানির শব্দ কানে কানে ফিসফিস করে;
কারণ সে জানে আমি একা একা কথা বলি,
এক অপরাজেয় স্বর্গের স্বপ্ন দেখি,
এক পেয়ালা শূন্যতা পান করি প্রতি দুপুরে।
অমরত্বের পিপাসা দারুণ!
ভবিষ্যৎ-স্বপ্নের পোড়ো বাড়িতে একটি ভোজের টেবিল;
সেখানে সাজানো আছে থালে থালে
ময়ূরের দুধ, হরিণের ডিম, শনিগ্রহের ঘাস
আহা! চমৎকার প্রাতঃরাশ!
৩.
উর্বশী
আমি ক্লান্ত উর্বশী।
জীবন-সমুদ্রের তলে বৃত্তের ভেতরে জন্মেছি।
বৃত্তের ভেতরের খাটে শুয়ে আমি বাইরে উঁকি দিই।
পেরিস্কোপ দিয়ে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখি, বৃষ্টিরও শব্দ শুনি।
স্বপ্নগুলো বৃত্তের ঘেরাটোপে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে,
তারপর পীড়নে দীর্ণ করে নিজের সত্তা ও শরীর;
আড়ষ্ট স্বপ্নগুলো পুরো দিগন্ত দেখার আকুতিতে
বৃত্ত থেকে বের করে চোখ;
প্রবল আত্মদ্বন্দ্বে অস্থির এ’ হিদ্রার মাংসল খোলস
খন্ড থেকে খন্ড হয়, অখন্ড সত্তা ভেঙে
কাচখন্ডের মতো চূর্ণ চূর্ণ সত্তা জন্মে,
বৃত্তের ঘেরাটোপে মৃত্যু হয় তার।
রান্না হই প্রতি পুরুষের নিজস্ব চুলায়
আর রান্না হতে হতে ভেড়ার কাবাব ব’নে যাই।
প্রতিদানে ঘৃণা ও ঈর্ষা উপহার পাই
যা আবার অন্য হাতে চলে যায় এই হাত থেকে।
গ্রাফ-কাগজের ঘর থেকে অন্য ঘরে
রাত-দিন দৌড়ুতে হয় ‘ঙ’ হয়ে।
আর ♫, ♥, ওঁ – এই চিহ্নগুলো স্থায়ী উল্কি মারে পিঠে
আর কারাবন্দী করে প্রতি রাতে।
সত্তার হত্যাকান্ড ঘটে।
অমৃত পানের ফলে মরেও বেঁচে থাকি;
বিষ-সমুদ্রের মধ্যে ভাসতে থাকি কলাগাছের মতো
আর ভাসতে ভাসতে নারদের গান শুনি।
আমার নিজস্ব পৃথিবী অরণ্য-পাহাড়-নদী-জ্যোৎস্না দিয়ে ঘিরে
সে চলে গেছে।
মাছিরা তানপুরা বাজায় সুমিষ্ট সুরে।
সূর্যরথ চলে গেলে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে আসে নেমে
আলকাতরা-মাখা রাত।
অভিশপ্ত এক নীল মাছি
পাক খায় শূন্য থেকে শূন্যের মৃত্যু-গহ্বরে।
সূর্যাস্তের রঙের মতো একাকী স্মৃতির আবৃত্তি
রাতকে তিমির করে।
শূন্য শোক – শূন্য প্রেম – শূন্য ও শীর্ণ রাত –
বনজ্যোৎস্না – হাহাকার – কাক –
এক পাল স্বপ্ন গায়ে চড়ে
গাল টিপে, কপালে ও ঠোঁটে চুমু দেয়,
এশরীর দু’হাতে জড়ায়, তারপর –
বাইরে বৃষ্টির শব্দ শুনি
ঝর্নার কলশব্দ কানে ভেসে আসে
পাখির কল-কাকলি তোলে তান
অন্তহীন বেদনার সুর শুনি আকাশে বাতাসে প্লাবমান
অজস্র চুম্বন, শীৎকার ও ফুলের বৃষ্টির মাঝে একেকটি রাত্রি খসে পড়ে…………..
বালিশে মাথা রাখি, ঘুম দিই,
স্বপ্নেও নাচতে হয়, যেন বা
স্বর্গের নাচ-সভায় নাচে এক সাপ।
নাচের তালে তালে ভূমিকম্প হয় আর
রুদ্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠি।
তারই মতো পায়ের তলা যায় ক্ষয়ে।
অট্টহাসির মতো ভেঙে পড়ে নীল কাচ,
তারপর নিত্যকার ভোর দেখি
যখন আকাশে
সূর্য উঠে, আলো দেয়,
ডুবে যায় পশ্চিমপ্রান্তে আবার সন্ধ্যে হলে।
৪.
লক্ষ্মী
আমার জন্মকাল থেকে
শুধু মুদ্রার ঝনঝন শব্দ শুনি;
মুদ্রার বৃষ্টি, মুদ্রার তুমুল ঝড়
স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জুড়ে বিস্তীর্ণ।
অমরতা মানে
মুদ্রার বৃষ্টিতে বার বার স্নান।
অর্থই অন্বিষ্ট সকলের – স্বপ্ন সুনীল।
মুদ্রার কারখানা থেকে বর্জ্য এসে
গঙ্গা ভরে যায় যমুনা ভরে যায়
সঞ্চয়-উপযোগ-খরচ-লিপ্সার অনুযোগ
কানকে বধির করে – কানে তালা দেয়
সত্তার বিপুল অন্ধকারের
মোহ থেকে মুদ্রাস্ফীতি, পী-রসের
মুদ্রা-দ্রবণ আর মুদ্রা-পতনের ঝনঝন শব্দ থেকে
স্বপ্ন নীলিমার, স্বপ্ন জ্যোতিষ্ক-জ্যোতির;
হোক তা সমুদ্রজাত জ্যোৎস্নাপ্রসূ চাঁদ
কিংবা তারকার।
স্নায়ুকোষে তীব্র সঙ্গীত, স্বর্গের সুরকারের
চোখে-কানে-ত্বকে লাগে ধাঁধা,
নাচের মুদ্রার তাল নষ্ট করে ধাতব মুদ্রা।
ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব কেনা হয়ে যায়………
প্রেম অর্থের সাথে – কামাচার অর্থের সাথে –
দৈত্যনাশ-পিপাসার চেয়েও এই অর্থলিপ্সা যথেষ্ট প্রকট।
নীল চেতনালোক অন্ধকার হয়ে ওঠে:
মুদ্রার শব্দ শুনে রাহু গিলে আলোর রথ, রথের সারথি,
তারপরও মুদ্রার ঝনঝন শব্দ তুলি…
শব্দের তালে তালে নাচের নূপুর বাজায়
সহোদরা নটী উর্বশী।
মুদ্রার বৃষ্টি, মুদ্রার ঝড়, মুদ্রার সূর্য, মুদ্রার রামধনু,
রাত্রি, স্বপ্ন, মদ –
সবই যেন ধাতু ও রক্তের মিশ্রণ,
রঙীন রক্তের হোলি,
শূন্য আকাশে রক্তের বিপ্লব,
অন্ধকার রাতের পূর্বমুহূর্তের গোধূলিতে
রঙীন সূর্যাস্তের ছটা।
অন্ধকার খনি যেন রূপকথার –
অন্ধকার সমুদ্র যেন অধরা স্বপ্নের।
শূন্য দিগন্তে শুধু হিসেব-নিকেশ
জমা-খরচের;
স্বৈরাচার-শোষণের সার্থকতার পরিমাপে
কারও গৃহে অঢেল লক্ষ্মী-পট,
আর কারও ঘর শূন্য, অর্থহীন –
এর অধিকার নিয়ে যুদ্ধ-সংঘর্ষ-রক্তক্ষয় অবিরাম –
পৃথিবী-বিস্তৃত এক বিশাল ঢোলে বাজতে থাকে অন্তরা………
শূন্য আকাশে মুদ্রাপরী উড়ে যায়,
জ্যোতির পরাগ ফোটে ওঠে,
সেই সাথে ভেসে আসে সরীসৃপের দীর্ঘশ্বাস।
মানবীয় পৃথিবীর অন্ধকার ভয়ে ব্যাঙেরা পালায়;
শূন্য থেকে শূন্য দিগন্তে প্রতিধ্বনি হয় মেঘেদের আর্তচিৎকারের,
যেন বা দেখে ভূত।
ফুলের অঢেল বৃষ্টি সারা রাত ধরে।
আতরের ঝাঁজ পেয়ে উড়ে আসে নীলকণ্ঠ পাখি;
রাক্ষসের বিলাপ শোনা যায়।
আদিম নৃত্য তোলে সাপ ও ময়ূর –
আকাশে আবীর রঙ লেপ্টে দেয়।
শিম্পাঞ্জির উল্লাস শুরু হয়,
ত্রিকালজ্ঞ নীল ঋষি ঘুম দেয় ঠান্ডা ভাঙা বরফের নিচে,
ডাকিনী মোহিনী সুর তোলে।
শঙ্কা কী? সকলে আমার কেনা দাস:
ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব এমনকি ইন্দ্র-নারদ।
রাহুকেও আন্তরিক প্রস্তাব দিই:
ক্রোধান্ধ দানব মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়;
তারপর হঠাৎ
বোঝে ফেলে অর্থমোহের ছলনা,
তারপর গোগ্রাসে গিলে সূর্য ও চাঁদ –
আলোকিত আঁধার ও অন্ধকার আলোকগর্ভ
আর তারপর শুধুই
অন্ধকার – অন্ধকার – অন্ধকার –
৫.
সুরা
বিশাল সমুদ্র-ঢেউ মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ে
রূপালী বালুর সৈকতে।
মরা মাছ ব্যাঙ সাপ শামুক ঝিনুক আরও কতো কী
একেকটা ঢেউয়ের সাথে করে যাওয়া-আসা
সমুদ্র ও বেলাভূমিতে।
মৃত্যু ও প্রাণের স্পন্দন ব্যাপ্ত সমস্ত রাতে ও দিনে।
ঢেউ এসে গ্রাস করে বিস্তীর্ণ বালির চরাচর – গ্রাস করে – গিলে খেতে থাকে –
বিরাট জল-ঢেউয়ে করি স্নান।
ঢেউয়ের ডানার নিচে বন্দী দাস হয়ে
অতল জলের ভ্রূণে ডুব দিই আর ভেসে উঠি;
সাঁতারও শিখেছি হলো বহু দিন।
সমুদ্র-সিঞ্চন মানেই
ডুবে ডুবে সাগরের তেতো নোনা জল খাওয়া,
নূনের অভিশপ্ত বিস্বাদ লাভ,
আকাশেও নোনা মেঘ দেখা।
সমুদ্রের নীল জলে সিক্ত হয়ে
আমাদের দিন কাটে, রাত কাটে, জীবন অতিক্রান্ত হয়।
নিরালোক গুহার তিমিরে যারা বাস করে সেইজনদের
সমুদ্র-জল-সিঞ্চন-লিপ্সায়
বিন্দুমাত্র আকুলতা নেই – অভিলিপ্সা নেই;
সমুদ্র-স্নানের তৃপ্তি শুধু আমরা অর্থাৎ
সমুদ্র-তনয়ারাই লাভ করি,
জলের সিঞ্চনে চুলকে সিক্ত করি;
এর অগাধ বিরাটত্বের স্বাদ
আমরা সুরেরা পাই,
অসুরেরা ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করে,
কারণ তাদের
জীবনের প্রতি, এর তিক্ত স্বাদের প্রতি
আনুগত্য নেই;
জীবনের মদ্যপানে আকুলতা নেই।
জীবনের তেতো স্বাদ মানে
রোদ-জ্যোৎস্না-বৃষ্টির অভিজ্ঞান:
সেই সাথে সাগরের নোনা জল পান।
শুধু ক্লিন্ন অমরতা সুরের লিপ্সা নয়;
এলিপ্সা শুধু দানবের।
অসুরেরা দর্পভরে পৃথিবীর মাঠে মাঠে হাঁটে,
সমুদ্রে মদ ঢালে,
লাশ নিক্ষেপ করে নিজেদের ও নিহত পাখিদের।
অন্ধকার হতে আরও গভীর অন্ধকারে
নামতে থাকে তারা,
অন্ধকার প্রেতাত্মার আরাধনা করে তারা,
যারা কিনা সমুদ্র-কন্যাকে চিরকাল
ঘৃণাই করেছে;
সমুদ্রের নোনা বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হওয়ার সাধ তাদের
কস্মিনকালেও জাগেনি।
এজলে কখনও কখনও আমরাও বীতশ্রদ্ধ হই:
স্বাদু জলের লোভনীয় লিপ্সা থেকে
অসুরত্বে দীক্ষা নিই;
আমাদের রক্তের ভেতর
সুর ও অসুর-শক্তি লেপ্টালেপ্টি লেগে থাকে।
শক্তির অভিমানে পরাক্রমে পৃথিবীকে নোংরা করি,
রক্তে বীর্যে জ্যাবজ্যাবে করি,
কাদালিপ্ত করি।
সুনামির মতো বিশাল নীল শাড়ি হয়ে
জীবনের রুগ্ন বেলাভূমিকে হিম জলে ঢাকতে আসে যে ঢেউ,
তার জন্য অসুরদের মাথাব্যথা আছে কি আদৌ?
বধূসাজে সজ্জিতা ধরিত্রীকে দীর্ণ করে
তারা লাশকাটা ঘরে ঘরে বেঘোরে ঘুমায়।
আর জীবনের অপার শোকের সমুদ্রে নৌকা আমাদের
চিরভাসমান
আর
যখনই ক্লান্ত আমরা ঠিক তখনই
চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন –
মৃত্যুর নোনা তিক্ত সাগর,
বিপুল তরঙ্গ-ক্ষুব্ধ অশান্ত ফেনিল;
গ্রহণের আঁধারেও সমান উত্তাল।
৬.
চন্দ্র
আমাকে তোরা আনলি কেন? ফিরিয়ে দে, ফিরিয়ে দে।
অন্ধকারের গর্ভলোকে আমাকে তোরা ফিরিয়ে দে।
আমি নীল কস্তুরী আভার চাঁদ।
আলোর মদ ঢেলে সত্তাসকলকে করি মাতাল ও স্বাপ্নিক।
আমার আকাশের
সমস্ত মাঠ জুড়ে বিস্তীর্ণ এক নীল জ্যোৎস্নার জাল।
নীলাভ শিশিরে ভিজে জন্মায়, মরে যায় ঘাস।
ঝিঁঝির একটানা কোরাসে স্তব্ধ সমস্ত কালো রাত;
মূক অশ্বত্থ গাছ ভাষাহীন কণ্ঠে গায় বেদনার গান;
আচ্ছন্ন ব্যাঙ তার গলা ছেড়ে ডাক দেয় ক্রোক ক্রোক ক্রোক;
বৃষ্টিভেজা রাতে তার সঙ্গিনীকে ডেকে চলে আলোস্নাত হয়ে অবিরাম।
সম্পর্কের নীলাভ বৃত্ত জন্ম নেয়।
আর প্রত্যেক বৃত্তের ভেতরেই একেকটি সবুজ আর্ডেন।
ঘাস হরিণ পাখি কীট মিলে
জ্যোৎস্নার দুনিয়ায় প্রত্যেকের নিজস্ব আর্ডেন।
উপজাত হলুদ বর্জ্য ত্যাগ করে আর্ডেনের পাখি।
আর ঘাস হরিণ পাখি কীট সবই
নীল ও হলুদ জলে স্নান করে চড়া সুরে গায়
প্রেম-ঈর্ষা-বিদ্বেষের গান।
জ্যোৎস্নার চাদরে নিজ শরীর ও সত্তাকে ঢেকে
সাদা-কালো-রঙীন আন্তঃসম্পর্ক পাতে পাখি-কীট-সরীসৃপ-ঘাস।
সম্পর্কের রঙ নীল, কখনও হলুদ আর কখনও বেগুনী।
প্রত্যেক (সাদা-কালো/রঙীন) সত্তার ভেতরে
ভিন্ন ভিন্ন নীল জ্যোৎস্নার শাল।
প্রত্যেক শালে ঢাকা সত্তার অভয়ারণ্যে কী থমথমে তুমুল ঝঞ্ঝা
তা অন্য সত্তা জানে না, দেখে না।
যে নীল জ্যোৎস্নার শেষে আকাশপ্রান্তে লাল রক্তের কুয়াশা,
জ্যোৎস্নার সাথে জ্যোৎস্নার অনুপম সংঘর্ষ,
সেই আলো সেই জ্যোৎস্না কখনও চাই না চাই না চাই না।
এর চেয়ে খাঁটি গাঢ় অন্ধকার ভালো,
এর চেয়ে শূন্যতা শূন্যতা ভালো।
আমাকে তোরা আনলি কেন? ফিরিয়ে দে, ফিরিয়ে দে।
অন্ধকারের গর্ভলোকে আমাকে তোরা ফিরিয়ে দে।
৭.
সরস্বতী
যখন সমুদ্র থেকে পারিজাত গাছটি উঠলো
ঠিক তখনই
ঘুম ভাঙলো আমার
স্ব পিতার শয্যায়।
সাথে সাথে আলোক-সমাচ্ছন্ন হলো আঁধার আকাশ।
ভয়ার্ত সূর্যদেব গা ঝাড়া দিয়ে
দিগন্ত-রেখাকে জ্যোতিষ্মান করে উঠতে লাগলো উপরে,
আমার তন্দ্রালু চোখ আলোর ছটায় দীপ্তিমান হলো।
প্রজ্ঞা মানে চেতনা,
আর চেতনা মানেই
জাগতিক অভিজ্ঞতার স্রোতে স্নান – তৃষ্ণা বঞ্চনা দুঃখ পরিতাপ।
শুধু তাই নয়, চেতনা মানেই
একান্ত কামনা প্রেম জ্ঞান অমরতা স্বপ্নের জলে শরীর-সিঞ্চন,
তারপর কল্পনা-নিরপেক্ষ দিনের উত্তাপে ঘামের ফোয়ারা,
আর চেতনা থেকেই কাম অর্থমোহ নিক্কণ-শব্দের বিলাস-বাসনা।
চেতনার শেষ দিগন্তে যে সূর্য উঁকি দেয়
তাকে গিলে খায় রাহু।
অতএব জ্ঞানের নীলাকাশে নিরবচ্ছিন্ন আলো নেই,
স্বপ্নের বাঁধভাঙ্গা প্লাবন নেই,
নিরাপদ তন্দ্রাভরা ঘুম নেই, চিরন্তন রামধনু নেই।
দারিদ্র্যক্লিষ্ট ক্ষুধাজীর্ণ তিক্তপ্রাণ যারা,
দিন আনে দিন খায় যারা,
তাদের ম্লান নিরালোক পৃথিবীতে এআলো পৌঁছে না,
তারা ক্রমাগত ক্রমাগত অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে…………….
প্রজ্ঞার দিগন্ত দিয়ে কামনা ও দুঃখের অমৃত-সূর্য উদিত হয়,
কিন্নর-কণ্ঠ শোনা যায়,
চেতনার নীল স্পর্শে আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকা জেগে ওঠে,
দুঃখ ও মৃত্যুর অভিজ্ঞতা লাভ করে,
যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়,
চেতনার নাম তাই
বি————ষ
জ্ঞানের, প্রজ্ঞার, চেতনার ময়ূরকণ্ঠী বিষের সমুদ্রে ভাসমান।
আকাশেও ভেসে চলে বিষ-মেঘ, ঝরে বিষের বৃষ্টি।
প্রজ্ঞা মানে বিষ,
চেতনা মানে বিষ,
চেতনার বিপর্যয়ে এই বিষ পান করে শিব।
বিষ তার কণ্ঠে লেগে থাকে,
মৃত্যু-নীল হয়,
তারপর যুদ্ধ হিংসা রক্তক্ষয়ও সংখ্যাতীত।
পারিজাত গাছখানি নিটোল বিষবৃক্ষ এক,
যার ডালে ডালে ডালে নাচতে থাকে বিষফল,
আর আমরা সবাই সেই
বিষফল ভোগ করে মৃত্যু-নীল হই।
অমর মরণ-বিষ আমাদের কণ্ঠে লেগে থাকে।
যেহেতু সাগর মন্থন করেছি আমরা
তাই জ্ঞানের এ’ মাকাল ফল খাওয়াও নিয়তি;
অর্থ প্রেম কাম ধন অমরতার অভিজ্ঞানও স্থির।
বারংবার আলোনাশ তিমিরের আচ্ছাদনও ধ্রুব।
পারিজাত ফল ও অমৃত ভোগের জন্য আগে
সমুদ্রের নোনা জল খাওয়া,
কালকূট বিষ পান,
তারপর আলো-আঁধারের খেলায়
চির-অবগাহন –
৮.
বলি
কৈলাশ-শৃঙ্গ থেকে শিবের তান্ডব-নাচের
শব্দ ভেসে আসে।
অন্ধকার দানবারণ্যে
প্রচন্ড উল্লাস-শব্দে চমকে উঠি,
ঘুম ভেঙে যায়,
পান করি এক পাত্র তৃষ্ণার মদ।
চারদিক থেকে দানবের পরাজয়-সংবাদ উড়ে আসে:
অচেতক বড়ি খেয়ে ঘুমাই ঠান্ডা নিরাপদ ঘুম
দৈত্য-প্রাসাদে।
পরাজয়-পিষ্ট হতে হতে পিঠ হিমালয় পর্বতে ঠেকে।
সমুদ্র দানবের রক্তে ভরে যায়।
সন্তানহারা দানবীর হাহাকার ওঠে।
আত্মার নম্র চড়ুই খাঁচা থেকে বের হতে চায়।
ঘুমের ভেতরে বৃষ্টি নামে।
নীল শূন্যে ভেসে চলা বিরাট কলস থেকে
অমরতা অর্থ কাম ঝরে পড়ে,
পাত্র ভরে সব নিই,
তারপর প্রিয় রাত্রি পার হলে সবকিছু আলোর দুঃস্বপ্নে ছেয়ে যায়।
পাতালের শিল্পী আমি।
স্বপ্নকে শিল্পরূপ দান করে স্ব জীবনকে সার্থকতা দিই।
শিল্পিত স্বপ্ন আঁকি আঁধার গুহায়,
নিউরনে আঁকি সূক্ষ্ম কারুকাজ।
পাতাল ফুঁড়ে বেরোয় অশুভ ইচ্ছের ফুল।
অন্ধকার চরাচরের পাখি ডেকে যায়
সুপ্ত পাতাল-গর্ভে।
আর ত্রিলোকের অন্য লোকে অন্য অন্ধকারে
কৈলাশের অধিপতি এক চড়ে নাচ-ভঙ্গ করে।
বীণা ফেলে সরস্বতী বেছে নেয় মদ ও আফিম।
সন্ধ্যার আকাশ ঘুম-ঘোরে কালো দেখতে পাই,
তাতেই মন-প্রাণ আনন্দে আঁধার হয়ে ওঠে আর
অমরতার পিংপং বলটি দিয়ে ভলিবল খেলি।
অমৃতের নীল মোহে অসুরেরা মত্ত হাহাকার তোলে।
শক্তিমান প্রতিপক্ষ বিজয়ী দেবতা
নারী প্রজ্ঞা অর্থ বিত্ত সব কেড়ে নিলো,
সুন্দরী চর দিয়ে ছলে নিলো আমাদের শেষ স্বপ্ন – অমৃত-কলস।
উর্বশী-লক্ষ্মী-অমৃতের সামনে
বাধা হলো বৃষ্টির শিঞ্জন, জ্যোৎস্নার উগ্র সাজ।
জেগে উঠলো দানবের রোষ।
ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হলো।
রক্তের প্লাবনে ভাসলো সমুদ্র ও স্থল।
অসংখ্য দানব-নারীর কান্নার রোল
উঠলো পাতাললোকে।
সমুদ্র রক্তিম হলো।
আকাশের পর্দা ছিঁড়ে জ্বলে উঠলো বিজলীর রেখা।
বৃষ্টিও যেন এক বিষের ফোয়ারা।
উর্বশী! উর্বশী! তার মাংসের জন্য এই মনে কামনা ছিল অতুল,
সেও হায় হস্তগত হলো ইন্দ্রের!
কামের পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত।
তার স্মৃতি নিউরনে জাগালো ক্রোধ অনিবার;
কালো গুমোট গন্ধ আকাশে বাতাসে।
প্লেটের ডিমের কুসুমটি আকাশে ছুঁড়ে মারি:
সেখানে ওটা সূর্য হয়ে যায়।
রক্তের সমুদ্রে করি স্নান,
সংগ্রাম দুর্জয় এ’ দানবের,
কারণ পরাজয় লেপ্টে দেবে খলনায়কের অভিধা কপালে।
আর তা’ই এখন প্রতীয়মান হচ্ছে স্বাভাবিক!
অমরত্ব অন্বিষ্ট আমার!
ক্ষমতা অন্বিষ্ট আমার!
অন্ধকার পূর্ণ চাঁদ অন্বিষ্ট আমার!
এ’ই নিয়ে ইন্দ্রের সঙ্গে বাজি।
রাহু? সে তো জন্মেই গিলেছিল এক রাশ আগুন ও বৃষ্টি!
আর অন্ধকারকে গিলে খেতে কোনো রাহু নেই;
রাহুর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
তার লক্ষ কোটি গ্রহণ থেকে লক্ষ কোটিবার মৃত্যু হবে আলোর –
এই ভবিষ্যদ্বাক্য আমার।
অমরতা! তুমি ধরা দাও।
শুভের আলোয় তুমি ভরো না এপৃথিবীর আকাশ,
অশুভের অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন কর,
দাও বিজয়-পতাকা,
দাও অন্ধকার
৯.
বিশ্বকর্মা
আমার দু’চোখে ঘুম নেই;
রাত-দিন শুধু হাতুড়ি-বাটালের শব্দ,
চুল্লির আগুনের গন্ধ,
কারখানার যন্ত্রের চিৎকার।
কে কোথায় কী অমরতা-প্রেম-স্বপ্ন নিয়ে নিবিড় পদ্য লেখে,
তাতে আমার কী আসে যায়?
সারা দিন-রাত
শুধু শ্রম, বেগার খাটুনি,
দাসত্বের গুরুভার।
অমৃতের পিপাসা নেই এক কণাও,
নিটোল যন্ত্রগুলোকে বরং ইচ্ছে হয় ক্রুদ্ধ কামড়ে খাই,
উর্বশী পারিজাত ফল স্বপ্নেও দেখি না;
বরঞ্চ মনে মনে লক্ষ্মীর হাত দিয়ে ফুলের দুঃসাহসী হাতুড়ি বানাই।
কারখানায় তৈরি করি মারণাস্ত্র:
তা দিয়ে কে কোথায় রক্তারক্তি করলো – মরলো –
স্বর্গে না নরকে গেল অথবা পুনর্জীবন পেল
সে’ কথা আমাকে শুনিয়ে লাভ নেই।
ঈশ্বর কে তাও জানি না অকপটে বলছি
লোহার পেরেক মারি কাঠের কফিনে।
চুলার উপরে শুয়ে দুঃস্বপ্ন দেখি:
চুল্লি, চিমনী, হামানদিস্তা, নাট-বল্টু থেকে
দুঃস্বপ্ন বের হয়, হাড়ের খুলিতে ঢুকে
হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে আমাকে তা মারতে থাকে।
ভয় হয় খুব;
যদি বাস্তবেও প্রভুর কাছে সেরকম –
যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের খতিয়ান কষে লাভ নেই
কিন্তু তাতে মালিকানা পাল্টানোর আশঙ্কাটা
পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে ক্রমাগত –
ইন্দ্র না বলি, বলি না ইন্দ্র, ইন্দ্র না বলি
অথচ আমার কণ্ঠস্বর তাদের সুউচ্চ স্বপ্নের তলে চাপা পড়ে যায়!
তাই অমরতা শুধু যন্ত্রণাই বাড়াবে।
লোহা ঝালাইয়ের কাজের সময়
আগুনের যে নীল ফুলকি বেরোয়
তা দিয়ে নিজের মনের শত স্বপ্নকে রান্না করি,
তারপর মর্ত্যের ঘাসের সাথে গুলে নিয়ে –
চিরকালের দাস
তার কথা ভবিষ্যতের মর্ত্যবাসীরা
হাতুড়ি-বাটাল-কাস্তের তত্ত্বকথা লিখে
লোহা আর আগুন দিয়ে গড়াপেটা করে নেবে।
কাজ নেই ইতিহাসের ছেঁড়া পৃষ্ঠায় অমরতা,
কালকূট বিষটি দিলে বরং উপকার হতো খুব।
চুল্লির আগুনের ভেতর গোলাপ ফুল পুড়তে থাকে অবিরতভাবে………..
আমার হাতে-হাতে হাতুড়ি-বাটাল,
মাথায়-ঘাড়ে হাতুড়ি-বাটাল,
মগজে হাতুড়ি-বাটাল।
আমার দিন আগুনের মতো ঠান্ডা!
আমার রাত বরফের মতো গরম!
হামান-দিস্তা দিয়ে পিষি রজনীগন্ধা ফুল;
শিল দিয়ে জ্যোৎস্নার রোদকে পিষে ভর্তা করে খাই;
গিলি স্প্রিট, সালফিউরিক এসিড;
প্রবল খিদেয় আমি চেটে খাই আগুনের শিশির………..
আমার দু’চোখে ঘুম নেই
রাত-দিন শুধু হাতুড়ি-বাটালের শব্দ
কারখানার যন্ত্রের শীৎকার
১০.
শিব
সাগরের তলা থেকে অমরতা-স্বপ্নের বাষ্প উঠে ইক্কার মতো।
কৈলাশের উপরের আকাশে জটলা পাকায় কমলা রঙের মেঘ।
জমতে জমতে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে গ্রীন-হাউজের কাচ।
তারপর হলুদ টুকরোগুলো ঝরে পড়ে প্রাসাদের ছাদে।
এভাবে লম্বা ছুটির পরে রাত্রি এলো।
পাতাল থেকে তোলা হলো এক কুড়ি ঘুমের আকরিক।
উঠলো উর্বশী লক্ষ্মী;
তারা চায় বরফের উম্।
কমলালেবুর খোসা ছাড়ালে তা থেকে যে বীজ বেরোয়,
তার মতো প্রেম জাগলো।
গোলাপের পাপড়িগুলো থেকে খুবলে পড়ছে খন্ড খন্ড রাত।
রঙীন জ্যোৎস্নারাতে দেখা যাচ্ছে মেঘের ফাঁকে উড়াল দেয়া
সারসীর সাথে অপ্সরীর প্রেম।
উর্বশীর হাতে প্রতি রাতে আমার স্বপ্নের বস্ত্রহরণ, বলাৎকার।
আর নারায়ণ? সে তো নর্দমায় রক্তকরবী ফুলের চাষ করে
আর লক্ষ্মীর কাছে নক্ষত্র ভাজার গল্প বলে।
∴ শক্তি= ভর ⨯ আলোর গতি²= তাল-বেতাল= নিঃস্বপ্ন ঘুম=অসীম শূন্যতা
বিশ্রী এক টিকটিকির সাথে
স্বপ্নগর্ভে খুনসুটি
বেগুনী রাতকে দেয়
হিমাগারের নাচঘরের উত্তাপ।
বরফের তেলে ভাজি কবরের মেঘ।
দু’হাতের ভাঁজ থেকে হাই ছাড়ি ৬১ সেকেন্ড পর পর।
আর চুলের জটায়ও জমে আছে ধূসর বীর্য।
আলমারি থেকে বের হলো ওঙ্কার,
টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের হলো ওঙ্কার,
ডায়েরির নীল অক্ষরগুলো থেকে বের হলো ওঙ্কার।
গালে আলতো চুমু দিলে যেভাবে সারা শরীর
প্রেম-স্বপ্নের স্পন্দনে আলোড়িত হয়ে ওঠে,
সেভাবে কেঁপে উঠলো সমুদ্র।
উঠলো কালো বিষ।
বিষপানে নীলকণ্ঠ পাখি হয়ে ডানা মেললাম।
আর তার কণ্ঠে শুধু দুঃসহ স্মৃতির বিষ, ব্যর্থ প্রেমের বিষ, সূর্যাস্তের রঙের মতো গাঢ় দুঃখের বিষ, ক্লেদ জীবন ও যন্ত্রণার কালো বিষ।
তার উপর আবার পারিজাত গাছ থেকে খেয়েছি জ্ঞানের বিষফল।
∴ জীবন= ভর ⨯ আলোর গতি²= যন্ত্রণার বিষ-দুঃখ
অনন্তকাল এভাবে
টিকটিকির মতো বিষ-দেহ নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে
এ’ শরীর কেউ ছোঁবে না
অস্পৃশ্য, অস্পৃশ্য, পাপ
একটি প্রজাপতি
তার ডানা ছিঁড়ে ফেললে যে নিদারুণ যন্ত্রণা
সেরকম তীব্র কষ্ট এখন আমার শরীরে
অনেক দিন আগে কৈলাশের গুহায় বসে টিকটিকি একটি মৌমাছির উদরে
কামড় বসিয়েছিল
নির্দয় কালো আকাশকে সাক্ষী রেখে জংলি পোকাটি সেদিন মরে যায়
আকাশের সে’ নিরবতার অনুশোচনার কষ্ট আজ আমার নিউরনে, সর্বাঙ্গে
অজগরের খোলস ছাড়ার কষ্ট
বালিকার প্রসব-যন্ত্রণা
নবজাতকের মাতৃশোক
সব মিলে একাকার হয়ে আমার শরীর জুড়ে তুলছে এক ঝড়
স্মৃতির বাতাসে বিস্রস্ত চুল
স্মৃতির বাতাসে বিষ
স্মৃতির বাতাসে ফুলের আর্তনাদ
চীঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈঈৎকার
স্ট্রবেরি ফলকে
শিল দিয়ে পিষলে যে লাল রস বেরোয়,
তেমন রক্তের ফোয়ারা উঠছে পৃথিবীতে।
অনিঃশেষ শত্রুতা-কোলাহল, যন্ত্রণার চিৎকার, ঢাল-বর্শা ভাঙার শব্দ;
সরীসৃপের বিষাক্ত নিঃশ্বাস রজনীগন্ধা ফুল থেকে;
মেঘের ধাক্কাধাক্কির মতো জাতিদ্বেষী সংঘর্ষ।
সমুদ্র এক রক্তের বাথটাব, বিষের ক্যাপসুল;
যেখান থেকে উঠে আসে
জ্ঞানের পারিজাত বৃক্ষ, বিত্তের লক্ষ্মী আর কাম-লিপ্সার উর্বশী অপ্সরী –
স্বপ্নের কাচ-বাক্সে যাকে দেখে শরীরে জন্মায় পী-রস,
মুদ্রার ঝনঝন শব্দ শুনে জিহ্বায় আইসক্রিমের লোভ,
নর্তকীর নাচের রিদম থেকে নির্ঘুম রাতের
অমোচনীয় জলতৃষ্ণা;
যা থেকে আবার মাৎস্যন্যায়, জুঁই গাছে শিমুলের জন্মের বাসনা থেকে
সকল ফুলের রাতভর সংঘর্ষ।
∴ জীবন= পারিজাত গাছ= লক্ষ্মী= উর্বশী= নির্ঘুম দুঃখ
তাই চাঁদ-সম্ভোগের চেয়ে তাড়িই ভালো
কারণ তা শূকরের মলকেও রেটিনায় অপরূপ করে তোলে।
বিবশা সূর্যের আবীর রঙের অন্ধকার, পাগলা সজারুর নাচ, সাগর-স্রোতের বিড়বিড়,
নীল বেড়ালের চোখ, ভূতুড়ে জ্যোৎস্নার রোদ –
এসবের সমষ্টি তরল মিকশ্চার হয়ে পরিপাকতন্ত্রে যায়, শুরু হয়
ক্লেদাক্ত পচন।
তখনই শিঙ্গায় ফুঁ দিই আর সাম্যবাদী নারীবাদী ধনবাদী ভূতের দল সঙ্গে নিয়ে
ধ্বংসের নাচ নেচে উঠি।
……নষ্ট ঘৃণার বৃষ্টি
ক্লান্ত রৌদ্রের
শিশির-স্বর্ণের দ্যুতি
প্রমত্ত আকাশের অতি তীব্র বজ্রের মতো
তীক্ষ্ণ চিৎকার হাহাকার রক্তপাত বিচূর্ণ পরাভবের মতো
রক্তিম উল্লাস
পদানত ব্যবচ্ছিন্ন শব
রক্তাক্ত পৃথিবীর জ্যাবজ্যাবে কাদার স্পর্শ
নিরুদ্দিষ্ট সীমানার ক্রান্তিরেখার ভ্রান্তি
কংজাংটিভাইটিস রক্তরেখা রেটিনার বিপরীত প্রান্ত-অবয়বে
প্রাকৃত কৃকলাস অতিমত্ত তিমিরের ভিড়ে
প্রমত্ত চিৎকার অগ্নিবৃষ্টি মাংসবৃষ্টি রক্তবৃষ্টি ক্রোধ…….
নিজেরই পায়ের তলা ক্ষয়ে যায় নাচ শেষ হলে।
আবার আফিম খেয়ে নিরাপদ ঘুম দিই কৈলাশের প্রাসাদ-কক্ষে
স্বপ্নের মদের পাত্রে চুমু দিই আর বলি
শুভ রাত্রি শুভ জ্যোৎস্না শুভ অন্ধকার
ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি
১১.
ধন্বন্তরি
বিশাল নাট্যশালার দর্শক আমরা সবাই।
সকালে সূর্য উঠলে যে জেগে ওঠে সবকিছু,
ঝিকমিক করতে থাকে ঘাসের শিশির,
শোনা যায় পাখির কলরব,
সেই সাথে সরীসৃপেরা লুকোয় গভীর গর্তে –
এসবের অভিজ্ঞতা পেতে পেতে শ্রান্ত ক্লান্ত এ ক্লিন্ন শরীর।
বিশাল পাহাড় বেয়ে যে মনোরম ঝর্না ঝরে পড়ে,
বরফ ভেঙ্গে চলতে থাকে আঁকাবাঁকা নদী,
কিংবা রাতের দিগন্ত ভেসে যায় জ্যোৎস্নার প্লাবনে,
অথবা বৃষ্টির নূপুর-শব্দে সৃষ্টি হয় সুরের লহরী,
এগুলোর স্বাদও পেয়েছি আমি ঢের।
ঠিক অন্য দেবতাদের মতো,
ঠিক নশ্বর মানুষদের মতো,
যেমনটা পেয়েছি
অন্যদের ঘৃণা-হিংসা-শত্রুতা-প্রবঞ্চনা-আঘাত।
সমাজসৃষ্ট বর্ণবিভেদের বলি,
অস্পৃশ্যতা-গোত্রবিদ্বেষের ক্রূঢ় শিকার আমার এজীবন।
স্পৃশ্যতা-অস্পৃশ্যতা, শ্রেষ্ঠত্ব-ক্ষুদ্রতার পার্থক্যের অভিমানে
আমাদের ক্লিন্ন অস্তিত্বের সিংহভাগ অতিক্রান্ত হয়।
আর মহাকালের বিশাল সমুদ্রে ক্রমাগত স্নান সেরে নিয়ে
আমরা লোকনিন্দা জাতিদ্বেষ পরছিদ্রান্বেষণে অংশ নিই,
ক্লান্ত হই,
আমাদের পায়ের তলার মাটি ক্ষয়ে যেতে থাকে,
আর সবার সাধারণ প্রতিপক্ষ সে’ মুহূর্তের জন্য
হরিণলোভী বাঘের মতো ওত পেতে থাকে,
এভাবেই আমরা ঈর্ষার অন্ধ মোহে ডুব দিয়ে
ক্লান্ত দীর্ণ অসুস্থ ও পরাজিত হতে থাকি,
পরাজয়ে জীর্ণ হতে থাকি,
শ্রান্ত হতে থাকি।
রাহু এসে গ্রাস করে আলো,
হয়ে যাই আলোর ভিখারী।
ক্ষুদ্র শীর্ণ জাতিবিদ্বেষের অপলাপে
অজানিত পরিভাষালোকে
নিজেদের নিক্ষেপ করি,
আত্মবিস্মৃত হই।
জানি জ্ঞানান্ধ ক্ষুধিত এক শূদ্র দেবতার এ আত্মবিলাপের
কোনো ফল নেই কোনো ফল নেই!
শুধু সমুদ্রের পাশে শুয়ে এর বিকট গর্জন শুনে শুনে
আমরা ঘুমের বালিশে মাথা রেখে
ঘুমঘোরে স্বপ্ন দেখি এক ভিন্ন ফুলেল ভবিষ্যতের
আর এসব প্রলাপ বকে চলি অবিরাম,
আর দেখি কখনও আলোর বানে ভেসে যায় বিশ্বপরিমন্ডল
আর কখনও বা কালো ম্লান অন্ধকারে তন্দ্রায় ডুবে যায়।
১২.
রাহু
কাটা ধরটি মর্ত্যের মাটির সঙ্গে রক্তারক্তি খেলছে;
ঘাসের শিশিরের সাথে রক্তের হোলিখেলা;
কণ্ঠে অবোধ যন্ত্রণা
সূর্যকে ছুরি দিয়ে কেটে কেটে তেলে ভাজি,
বার বার গিলে খাই,
গলা দিয়ে তা বেরোয় দুর্গন্ধের বর্জ্য মলের মতো।
অসহ্য এই আলোর যন্ত্রণা!
অনূর্ধ্ব-৩ শিশু মায়ের অদেখাকে যতোটা ভয় করে
ঠিক ততোটা বিদ্বেষ আমার এই বাতির বলের ওপর।
গ্রীন-হাউজ মশারির ফাঁক দিয়ে পৃথিবীতে ঢুকছে আলোর মশা;
শূন্য থেকে বের হচ্ছে আলো, নাইন-ও-ক্লক ফুলের গর্জন;
রোদের টনিক খেয়ে বাড়ন্ত সূর্যমুখী;
রামধনু নিয়ে লোফালুফি করছে এক ঝাঁক স্প্রিংবাক;
অজগরের মল থেকে বেরিয়ে আসছে জুঁই ফুল;
মেঘেরা দৌড়ে পালাচ্ছে সারসের চিৎকারে;
আর আঁতুড় ঘর থেকে কানে আসছে
নতুন তারার ওঁয়া ওঁয়া ডাক।
অসহ্য! ওহ্! অসহ্য!
ইচ্ছে করে ওই পিংপং বলটি ছুঁড়ে দিই;
সিঁড়ি দিয়ে ড্রপ খেতে খেতে তা হারিয়ে যাক
রডোডেনড্রন ফুলের মতো শূন্যতায়।
আধমরা ‘দানব’ আমি।
মৃত্যুর স্বাদের মতো মিন্টের হিম
কখনও পাবো না।
তদুপরি এই মাথা স্বভাবসিদ্ধ শরীরী জীবন থেকে দূরে;
স্বাভাবিক যে জীবন জ্যোৎস্না-রোদ-বৃষ্টিমাখা
তার সাথে এর কোনো নৈকট্য নেই;
সম্পর্ক নেই।
পানাহার-খুনসুটি-জ্যোৎস্নার স্নান ছাড়া
এজীবন মৃত্যুর চেয়েও কঠিন।
স্মৃতিও কর্কশ।
এক খলনায়কের প্রার্থনা শোনার কোনো দয়ার্দ্র প্রভু নেই,
কেউ নেই, কেউ…….
কড়া চায়ের মতো বাষ্প উঠছে নরকে।
গরম কড়াইয়ে সেদ্ধ হচ্ছে তাল-বেতালের মাংস। বিলাপ অর্থহীন।
সূর্য তার নিউরনে কার্বন কাগজ ফেলে আলকাতরার আলোর যে প্রতিলিপি করেছে তার কাছে
আমরা পরাজিত।
আর পরাজিত প্রজাতির নামে ব্লটিং কাগজের পক্ষে অসাধ্য কালো ছাপ ওঠে।
ইতিহাসের ছেঁড়া পাতায় স্থান হয় তার, তারপর মিথের আস্তাকুরে।
তার লাশ বাঘ-হরিণ-পাখি-কীট এমন কি ঘাস-ফুল-মেঘ এরা সবই
খুবলে খায় উৎসাহ নিয়ে।
তবু এ’ নিশ্চিত:
আমরা অস্তিত্বহীন কখনও হবো না।
নিজের কাটা কবন্ধ আগুনে ঝলসিয়ে বানরকে কাবাব খাওয়াবো।
আলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে চিরকাল…….
তবু আবারও কেন সেই দেদীপ্যমান সূর্যেরই উদয় দেখি?
তার বাসী শরীর থেকে উৎকট বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে।
নিইইইইইইইইইপাত যাক।
দীপ্তিকে আমার দ্বেষ, অমৃতকে আমার ঘৃণা, আলোর সঙ্গে আমার দ্বৈরথ।
যতোই শিরশ্ছেদ করে কবন্ধের কোলাজ বানাও
তুমি শক্তিমান আলোর উৎস,
রাহুর করাল গ্রাস থেকে মুক্তি নেই মুক্তি নেই মুক্তি নেই!
অমর অন্ধকার হতে
মুক্তি নেই মুক্তি নেই মুক্তি নেই!
পোষা কাঠঠোকরার স্মৃতির নামে এ’ আমার অঙ্গীকার,
এ’ আমার মৃত্যুহীন অভিশাপ –
মৃত্যুহীন, মৃত্যুহীন, মৃত্যুহীন, মৃত্যুহীন, মৃত্যুহীন……….
১৩.
দিতি
নিরক্ত পান্ডুর গোধূলি।
আমি দিতি; স্বপ্ননীল বৃত্তবন্দী আবিষ্ট তিমিরাকীর্ণ নারী।
অন্ধকার স্বপ্নপিষ্ট, স্বপ্ন কি জরায়ুর তৃষা?
মূূঢ় পিপাসার প্রাকৃত ম্রিয়মাণ আলো
জেগেছে স্নায়ুতে আজ কালসাপ সত্তায় আমার।
যন্ত্রণার দংশনে দীর্ণ শীর্ণ ওই চাঁদ
প্রত্যেক সন্ধ্যায় উঁকি দেয় প্রতারক স্বপ্নের ভেতর।
খন্ড থেকে খন্ড হয় ধ্বংস হয় লীন হয় প্রতি কাল রাতে
দ্যুতিময় প্রাচুর্যের শূন্যতায় পূর্ণ এ তন্দ্রার্ত স্বপ্ন শহর।
অন্ধকার শূন্যতায় কালো এক বেড়ালের ডাক
শূন্যতর করে মন, ব্যক্তিগত পাথুরে গুহার
দেয়ালে ধসের চিহ্ন, প্রতি প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর কীটের দংশন।
দুর্লভ প্রজাতীয় বহুরঙা প্রজাপতির
ছেঁড়া লাশ ভেসে ফেরে দিকভ্রান্ত বাতাসে বাতাসে।
অতএব, আর লাবণ্যঋদ্ধ পূর্ণিমার থাকলো কী বাকি?
এসো প্রিয়, দুঃস্বপ্নের মালা গেঁথে লিখে চলি ঘৃণা –
দ্বেষ ও দীর্ণতার সীমা ছেড়ে ভ্রান্ত উল্লাসে মাতি,
সারা রাত গেয়ে চলি ক্লেদক্লিষ্ট অভ্যাসের রক্তস্নাত লেখা,
আনন্দের কণা থেকে প্রতিদিন শুঁষে নিই নীল মৃত্যুবীজ!
দংশন-দীর্ণ এদেহটিকে করে নিয়ে প্রেমের মহল
মদিরায় মাতাল হয়ে একটানা বকে যাই মৃত্যুলীন সন্তানের আশা।
অব্যক্ত অধরা শব্দে কালকে আর দেবো না গঞ্জনা;
যদিও আকাল আজ, বন্ধ্যা খরা মাঠে মাঠে নষ্ট শস্যের।
বিপুলা পৃথিবী
আমাদের হত্যা করে
লাল রক্তে হোলি খেলা করে,
গোধূলির মুহূর্তকে রক্তাক্ত করে।
আর এখন
আমারই পেটের সন্তানের কাটা দেহ
রক্তে জ্যাবজ্যাবে হয়ে মর্ত্যে গড়াগড়ি খায়,
আমি নিরুপায় নিস্ক্রিয় সাক্ষী থাকি,
আর সপত্নীর সন্তানেরা সৎভাইয়ের রক্তপানে হিংস্র উল্লাস করে।
আর আমার এ’ নিস্ফল অশ্রুপাতে অন্ধ বিধাতার আদৌ কি দয়া হয়?
জানি আর্তনাদ আর্ত-চিৎকারে কোনো ফল নেই,
কারণ ধরিত্রীর রীতিই এটাই,
সংকীর্ণ স্বার্থপরতার প্ররোচনায় আমরা সবাই
জ্ঞাতিঘাতী ভ্রাতৃঘাতী কলহে সংঘাতে লিপ্ত হই,
মর্ত্যের মাটিকে ক্লিন্ন রুগ্ন রক্তাক্ত করি,
আন্তঃসাম্প্রদায়িক হিংসায় উন্মত্ত আমরা
সোল্লাসে রক্তের বাঁধভাঙা নদীতে স্নান করি।
আহার্য, বিলাস, বেশ, অস্তিত্ব, মোক্ষলাভ – এদের তাগিদে
প্রত্যেকের আত্ম-হাহাকারে অন্য কারো মস্তিষ্ক-প্রক্ষালন নেই, অনুকম্পা নেই।
ক্ষুদ্র ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের পরতেও প্রত্যেকের ব্যাকুল চেষ্টা বুকফাটা স্বতন্ত্র চিৎকার
অন্য কেউ শুনতে পায় না, কেউ…….
স্ব অস্তিত্বকে ভিত্তি দিতে, সার্থকতা দিতে
অপরকে আকুলভাবে ভালোবাসি, সমর্থন করি।
অন্যের তাগিদে তীব্র কামনা ও চরম হাহাকারের
পশ্চাতের মূল সত্তা আমরা নিজেরা।
হৃদয় তাহলে কী?
তবে কি তার মানে
সংকোচনে দীর্ণ হতে হতে ছোট্ট ঝিঁঝি পোকা হয়ে যাওয়া?
সাইরেনের গম্গমে আওয়াজে সংকীর্ণ আত্মমগ্নতার গান গাওয়া?
হৃদয়বৃত্তি কি তাহলে
এক রক্তিম জ্যাবজ্যাবে কাদার কুন্ডলী? খাঁচার ভেতরের আবছা অন্ধকার?
নীল কাচঘরের মধ্যকার
প্রতারক মোহিনী পূর্ণিমা?
জাগতিক অভিজ্ঞতার অভিঘাতে
আমাদের প্রেম-করুণা-মূল্যবোধ ক্ষয়িত হতে থাকে,
ক্ষয়িত হতে হতে শূন্যতায় অন্তর্হিত হয়।
আত্মহত্যায়ও পরিত্রাণ নেই,
এবং অস্তিত্বে প্রত্যাবর্তনও ধ্রুব নিশ্চিত,
যদিও বিষের সমুদ্রে আমরা চির-ভাসমান।
নইলে যদিও স্বপ্ন সাধ লিপ্সা ও লক্ষ্য অঢেল,
অস্তিত্বের সাদামাঠা অর্থই হলো
শিববৎ জীবন-মন্থিত তিক্ত রক্তাক্ত হলাহল পান।
জানি একথাগুলো আবৃত্তিতে কোনো কাজ নেই।
কেননা আমাদের পরিণতিই হলো
বেআব্রু নোংরা অভিজ্ঞতার কাদায় শরীরকে পিচ্ছিল করে
বিমূঢ় নীল নস্ট্যালজিয়ার জলে স্নান করা।
নিজেদেরই আনন্দ-বিষাদ-বিমূঢ়তায়
আমরা আবিষ্ট থাকি, বিহ্বল-বিশীর্ণ হই,
তারপর দু’দিনের জীবন-উৎসব শেষে
মৃত্যুর সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাই অন্ধকার অভিজ্ঞান-লোকে।
১৪.
নীলকণ্ঠ
আজও সেই অপ্সরাটির কথা মনে পড়ে যায়
ঘোর বর্ষার দিনে,
তার পাখা মেলবার মুহূর্তটির স্মৃতি
ছায়াচিত্র হয়ে যায় চোখের কর্ণিয়ায়।
ক্ষমতা বিত্ত শিল্প অমরতা আজ সব আমার অধীন।
সে’সঙ্গে চিরস্থায়ী অন্ধকার
কণ্ঠে চিরদিনের জন্যে লেগে থাকা নীল বিষ,
অজানিত কাল ধরে বিষের ক্লেদাক্ত দহন,
যন্ত্রণার তীব্র নীল বিপর্যয় ভার
দুঃখের দুর্বিষহ ক্লেদ
উন্মত্ত স্বপ্ন আজ আমাকেও রিক্ত-নিঃস্ব-দেউল করেছে;
শরীর ও মন আজ অব্যাখ্যেয় দুঃখের পুকুর;
তিলোত্তমা এক হরিণী ডেকে যায় বুকের গর্ভে ভরা জ্যোৎস্নায়;
মায়াবী পূর্ণিমায় ঢাকা আত্মার নিখুঁত পিঞ্জর।
মন্থিত লুন্ঠিত নীল সমুদ্র নিলো নিঃশেষিত হওয়ার প্রতিশোধ:
যুদ্ধে হিংসায় লাল রক্তে ভাসলো নীল গ্রহ,
পরিণত এবয়সে নীল বিষ প্রজ্ঞা জোগালো অবিরাম,
বিষাক্ত বিষ-নীল তাই এ’ মনীষার আস্বাদ।
এ’ সমুদ্র মথিত না করাই ভালো ছিল আজ জানি ঢের –
নিদারুণ উপলব্ধি আজ এই বৃদ্ধ প্রাজ্ঞের।
বিষাক্ত এ’ অমরতার চেয়ে ধূসর মৃত্যুর স্বাদ
ঢের বেশি সুখকর ছিল
যা আমরা পেয়েছি যুদ্ধে সংঘর্ষে রক্তক্ষয়ে অবিরাম।
সাম্রাজ্য নির্মাণের তিক্ত বিস্বাদ ক্লিন্ন চেতনা
ইন্দ্রের সাথে আমি করছি আজ ভাগ-বাটোয়ারা –
এস্বাদ বিষ-নীল,
এস্বাদ রক্তিম।
চৈতন্যের সর্বনাশা রুগ্নতার পোড়া স্মৃতি
পৃথিবীর সব রঙ আমার চোখে মুছে দিতে থাকে।
সাজানো বিছানায় শুয়ে শুনি আজ নারদের গান,
উপভোগ করি নাচ উর্বশী ও অন্য অপ্সরীদের,
রাত্রি গভীর হলে ঘুমাই স্বপ্নহীন ঘুম।
একেবারে সবার উপরে আমি বসে আছি, তাই
অসহায় প্রাণের আর্তি প্রার্থনা করারও পাত্র নেই!
আর তাই
অদৃশ্য সত্তার কাছে নিরাশ্রয় নির্জনে প্রাণপণ জপ করে চলি
মৃত্যু দাও
মুক্তি দাও
চেতনা বিলোপ কর চিরতরে
নির্বাণ নির্বাণ নির্বাণ দাও
নাকি নির্বাণেও পরিতৃপ্তি নেই
সেই চেতনার বশে আমি তাই
সমুদ্রের তীরে তীরে ঘুরে এর প্রতিটি ঢেউকে করি প্রত্যক্ষ
আর মৃত্যুশীল প্রাণীদের জন্ম-জন্মান্তরের
মহাকাব্যিক বিশালত্বের স্বাদ নিয়ে
নির্লিপ্ততার জলে অনন্তকালের জন্য স্নান করে চলি
১৫.
নারদ
স্বপ্নের সমুদ্র থেকে অমৃতের উঠে বুদবুদ;
ঘোর রাতে ঘুম-ঘোরে প্রবল পিপাসা দেয় চাড়া;
মোরগ-শাবক যেমনি খুঁটে খুঁটে খায় ছোট খুদ,
তৃষ্ণা ফুরালে ফের শুরু হয় প্রাণের অন্তরা ॥
মাকড়সার মতো স্বপ্ন-জাল বুনে চলে বিশীর্ণ হৃদয়ে,
স্বপ্নের অজানা মূর্তি গড়ে চলে দীর্ঘ সময়।
স্বপ্ন পূরণ হলে ঘোর রাত্রি ধীরে যায় ক্ষয়ে;
তারপর নতুন স্বপ্ন চাড়া দেয়, চোখ ক্লান্ত হয় ॥
কাটা কবন্ধের জন্য শোকের বিষাক্ত শ্বাস জোরে ফেলছে রাহু;
তার ভয়ে সূর্য-চাঁদ-পৃথিবীও গুনে যাচ্ছে কাল।
আতঙ্ক – যদি বা তারা অন্ধকারে ডুবে আর কমে যায় আয়ু;
যদিও অমাবস্যার শেষে ভোর হয়, তারপর সোনার সকাল ॥
আমিও ছন্দ গড়ি, বিষয়বস্তু বিকেলের মেঘ,
ডুব দিই মদের রাজ্যে অন্য সব দেবতার মতো;
অমরতা-জ্ঞান-ধন-প্রেমের তাড়না দেয় বেগ;
পরে নীল ব্যর্থতায় হয়ে যাই ক্লান্ত, আশাহত ॥
ক্লিন্ন কবি ব্যাঙ্গমার খাঁটি কাম-লিপ্সার মতো
আমিও প্রতি রাতে স্বপ্নে শুনি নূপুরের তাল।
কামাতুর ইন্দ্রের মতো উর্বশীকে জানাই স্বাগত,
তারপর চোখ মেলে ঊর্ধ্ব শূন্যে দেখি মহাকাল:
রাহুর কাটা মুন্ডু নিয়ে খেলা করে সূর্যের দৈব তলোয়ার;
আঙ্গুলের ইশারায় ধূর্ত দেব শূন্যতায় কবন্ধ উড়ায়।
সাগরের শূন্য জল খাঁ খাঁ ক্রুদ্ধ সাপের শিকার;
সোনালী চাঁদের চোখ রক্তমাখা গ্রহটাকে জড়াসার বানায় ॥
নামাবলী বদলের মতো বোধ, মানে উচিত-অনুচিত
তাও পাল্টায় চিরচেনা স্বভাবসিদ্ধ নতুন কামনায়;
আমার এ’ শকুন সত্তার পলাতক অস্তিত্বের ভিত
নিস্ক্রিয় স্রষ্টার মতো চিরকাল গান গেয়ে যায় ॥
রচনাকালঃ ২০০৮-০৯
ওয়েবসাইট সংস্করণের জন্য সর্বশেষ পরিমার্জনাঃ সেপ্টেম্বর ২০১৪
Printed Version:
Comments are closed