অনন্তিম
অপ্রতিম রাজীব
ক্রোমিয়াম সিটি
চলছি বাই-ভার্বালে চড়ে। লেজার-ব্রিজের উপর দিয়ে।
পেছনে অনেক স্মৃতি ফেলে যাচ্ছি সামনে পরাবেগে।
ভেতরের কপোট্রনে মেঘের মত
জমে গেছে বিষাক্ত এসিড।
লিরা আমাকে আজ ‘না’ বলেছে।
আজ আমি তাকে এক প্রজন্ম-৫ রোবোটের সাথে দেখেছি।
ওই রোবোটের সাথে সাক্ষাৎকালে তার চোখ থেকে
বেরিয়েছিল নীল লেজারিত আলো।
রোবোটের ঠোঁটে ছিল ক্রোধের লাল ডিজিটাল লাইট,
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেমিককে দেখে।
আর আমার কপাল থেকে হলুদ এক আলো ঠিকরে পড়ে
তিন আলোর সংঘর্ষে ঘটল এক তীব্র বিস্ফোরণ।
আজ ভাবি লিরা কি সত্যি নাকি ওমেগা পিসি-তে তৈরি
ত্রিমাত্রিক এক হলোগ্রাম?
পেরিয়ে যাচ্ছি লেজারের ব্রিজ, নিচে সমুদ্র, আর তার নিচে
সাবওয়ে হিমাগারে শুয়ে আছে লাখ লাখ নারী,
তাদের দেয়া হচ্ছে কৃত্রিম অক্সিজেন,
তারা সব ঘুমে মগ্ন
হাজার বছর ধরে।
একদিন কোনো এক উৎসবের দিনে
জেগে উঠে বল নাচ নেচে উঠবে তারা।
কেন তারা শূন্য ওই তলদেশে
বেঘোরে ঘুমায়?
একদিন তারাও এ গতানুগতিক পৃথিবীর এ ঘিঞ্জি শহরের
নাগরিক ছিল, একদিন তাদেরও হৃদয়ে
ফাল্গনের নাইন-ও-ক্লক ফুল ফুটেছিল, তাদেরও আকাশে একদিন
রূপার বলের মত চাঁদ উঠেছিল।
নীল কাগজে তারাও নীল চিঠি লিখেছিল,
তারপর গোলাপ দেয়ার সময় তাদের ঈপ্সিত তরুণেরা
সৌরভ না নিতে পেরে নিল এর কাঁটা।
.. … … তাই প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকারা পৃথিবীর নীল স্বাদ তিক্ত পেয়ে
অন্য এক দূর নীল পৃথিবীর খোঁজে
অক্সিজেন-সাপোর্টে থেকে এক নীল ডিজিটাল স্বপ্ন দেখে দেখে
নীল সুখটানে এক দীর্ঘ ঘুম ঘুমানোর পর
হাজার বছর পর আবার হাঁটবে এ পৃথিবীর উপর।
পৃথিবীতে অমরার সুখ চেয়েছিল তারা?
প্রযুক্তির পরাগতি পরীদের পরাস্বপ্ন পূরণ করেনি।
তাদের করোটিতে ছিল নাট-বল্টু ও বকযন্ত্রের কলা,
গোলাপের সুখছবি স্বপ্নে ছিল আজন্ম অধরা।
তাই ক্রিস্টাল ডিস্কে ভরা স্বর্গের ছায়াছবি তাদের মগজে ভরে
হাজার বছর পর পরিবর্তিত পৃথিবীতে এনে
নবজাত প্রেমিকেরা তাদের হাত থেকে
পেতে চায় সতেজ ওমিক্রোণিক গোলাপ
যাতে থাকবে না একটিও কাঁটা।
তারপর তারা এই নরকের এ নতুন রেপ্লিকায়
টোপোক্রোণিক দুঃখ-সুখ করবে ভাগাভাগি।
ঘুমন্ত মানবীরা
এরপর এ পরাবর্তে পারবে কি তারা দিতে কাঁটাহীন প্রেমের গোলাপ?
১৯.২.২০১৬
ভূত–নাচ
পড়েছে কত চুম্বনের দাগ
এই নীল ঠোঁটে, কতদিন সন্ধ্যার অস্তরাগ
ভাগাভাগি করেছি দু’জনে, আর
কত খুনসুটি, আকাশে উড়েছে লাল-নীল সূর্যাস্তের মেঘ,
রক্তিম গাল ছুঁয়েছে বসন্তের ফুল, আর নানা রঙে স্নান করা প্রজাপতি
অস্তরাগকে আবিষ্ট করে
নীল জ্যোৎস্নার গান গেয়ে গেছে স্বপ্ন-সন্ধ্যায়।
কত রাত কাটিয়েছি নির্ঘুম, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে দেখে,
ঘুমের স্বপ্ন থেকে শরীরকে ছলনায়
করেছি বঞ্চনা, পার্কের বেঞ্চে বসে পাশাপাশি
স্বর্গের অমরলোক লিখে গেছি কত, আর মাথার উপরে মগডালে
রূপালি চাঁদের বল শুধু হেসে গেছে।
হঠাৎ একদিন দেখি পাশে তুমি নেই,
ঘরে নেই, ছাদে নেই, পার্কেও নেই,
ছবিঘরে চলমান টিভিস্ক্রিণে স্বপ্ন হাঁটছে লাল-নীল-রূপালি-হলুদ
এতোকাল জমে থাকা রাত-স্তূপ থেকে।
সকল চ্যানেলে শুধু ভূত আর ভূতের তান্ডবে
অতিষ্ট পৃথিবী।
বেরোই রাস্তায়। সেখানে যত চলমান নর-নারী চেনা বা অচেনা
নিয়েছে ভূতের সাজ, ভূতের চেহারা।
তাকানোর ভ্রূকুটিতে শত ওয়াট ক্রোধ।
তারপর চারপাশে জড়ো, আর তারপর আমাকে ঘিরে
শুরু হল আগুনের নাচ, কিমাকার ভৌতিক নাচ।
বিশাল এক মৃত্যুর পাহাড়ে
অজস্র ভূতের নাচ শুরু হয় – হাজারো ভূতের
কিমাকার তান্ডব নাচ
নদী বন মেঘ আকাশ চরাচর জুড়ে শুধু ভূতের সাম্রাজ্য
স্পর্শাতীত শূন্য থেকে অন্ধকার অতল পাতালে
সব স্থানে অজস্র নীল ভূতের ভিড়
কীটদষ্ট মুখ ঢাকতে কখনো বা তারা
লাগায় রক্ত-মাংসের রঙীন মুখোশ
রঙধনুর মতো দীপ্ত ব্রিজ তৈরি করে
আকাশের রঙ্গালয় থেকে নেমে আসে
সমস্ত গ্রহটাতে শুধু মত্ত ভূতের মিছিল
ভূতের এ দাবানলে আর আমি খুঁজে ফিরি তোমাকে শুধুই
১৭.৩.২০১৬ ০৫.০৬.২০১৬
সে আর আমি
(ইলু-কে)
সে তার খেলার কথা বলে যায়, আমি শুধু
স্বপ্নের স্রোতে ডুব দিয়ে অন্য এক পৃথিবীতে
মগ্ন হই, মেঘ দেখি, বৃষ্টি দেখি, অগ্নির গিরি দেখি,
আর সুইফ্ট্ পাখি হয়ে আদিগন্ত চরাচর
ঘুরে ঘুরে স্বপ্ন দেখি ঘুমের ভেতর।
সে তার খেলার কথা বলে যায়,
ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট ছোঁয়, গাল টিপে, নানা রঙা পুতুলের
আবদার আর কতো রাগ-অভিমান, কতো খুনসুটি!
আমি জানালার ফাঁক দিয়ে শূন্য আকাশ দেখি,
বিশীর্ণ চাঁদ দেখি, বৃষ্টি ও জ্যোৎস্নার
নাচ দেখি, ভূতের একাঙ্কিকা……..
তারা সব অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে,
ভাবে দু’টি শীর্ণ শব
স্বপ্নজাল ঘেরা গ্রহে হয়তো পেতো পূর্ণ এক নীল স্বপ্নবাসা
যেখানে তারা শরীর কখনো নয়, পুরোপুরি স্বপ্নগড়া মোমের পুতুল…….
ভেবে ভেবে চাঁদ ডুবে, মেঘ ডাকে, পেঁচা উড়ে যায়,
এরাতের ইতিকথা হয়ে যায় চিরন্তন মরা রূপকথা –
আমার সহজ স্বপ্নে আমি দেখি ভূতের একাঙ্কিকা………
৪.০৬.২০১৬
আমি সতৃষ্ণ চোখে চেয়ে থাকি
আমি সতৃষ্ণ চোখে চেয়ে থাকি
বিষণ্ণ আকাশ জুড়ে মেঘেরা সারা দিন করে ফিসফিস
রাত নেমে এলে নিরালোক সুরমার জলে
আলোর নাচ শুরু হয়
মৃদু আলো, গাঢ় আলো, সাদা-লাল নানা আলো ভরা জলে খেলে
দৃষ্টির সীমা জুড়ে ভরে যায় বেঠিকানা কচুরিপানায়
আলোর রোশনাই দূরে সরে যায়
তারপর শুরু হয় বৃষ্টির গান
সমস্ত রাত জেগে ব্যাঙেরা ডাকে
সোনা ব্যাঙ কোলা ব্যাঙ মরা ব্যাঙ হাজারো ব্যাঙের ঝাঁক
মৃত্যুর গান গেয়ে রাতের পৃথিবীতে করে জীবনের উদ্দাম উৎসব
ডাঙা দিয়ে শুধু আনাগোনা
অশরীরী ছায়ার
বিমর্ষ বাতাস ঠেলে স্মৃতিরা হেঁটে চলে
বৃষ্টির চুল ছুঁয়ে মৃত শতেক স্মৃতির
হাতকে হাঁতড়ে ফিরি
আকাশে আকাশে এক ফেরারি আক্রোশ ওঠে
স্মৃতি ও সত্তাকে মত্ত দাপটে কাঁপায়
হে নীলাকাশ, মৃত সহচর তুমি ভরেছিলে আমার আকাশ
মৌরীর গানে গানে
ফাল্গুনের ভোরের আগুনে
এবার এ বিষণ্ণ বর্ষায় আমার সত্তাকে ধোও
ঝড়ো বৃষ্টির ঝাঁজে,
আর
স্মৃতির করেটিতে শান্ত লণ্ঠন জ্বেলে
বৃষ্টিভেজা কুঠরিকে আলোর দীপ্তিতে ভরো।
৩১.০৫.২০১৬
দু’জন
মেঘ ডেকেছিল ফিসফিস করে মেঘকে
তুমি আর আমি ঘাসে বসা পাশাপাশি
রাত ডেকেছিল নির্ভার হয়ে চাঁদকে
বাগানবিলাস তাই হেসে কুটিকুটি।
তারায় তারায় এঁকেছি স্বপ্নজাল
রাতের আকাশে মেঘেদের লুকোচুরি
চুমুর স্বপ্নে তুমি পেতেছিলে গাল
স্বপ্নের মদে গোটা গ্রহ ঘুমপুরী।
বাঁশের বাগানে চাঁদ দিয়েছিল উঁকি
স্বপ্নের স্রোতে ভেসেছি শূন্যে দু’জন
সারা রাত ধরে আকুতির আঁকিবুকি
ঘুমের পরীর ডানায় সমর্পণ।
ঘুম সারা করে গা ঝেড়ে সূর্য লাল
দেখেছিল ঘাসে শোয়া দু’টি কঙ্কাল
বিলাপে বাতাস ভরেছিল ডাক ডাকিনী
আকাশে ও ঘাসে নীল নির্যাসে বেজেছিল সিম্ফনি।
৭.০৬.২০১৬
একটি নোটারিত হলফনামা
তুমি আমার আকাশের মেঘ, আমার পূর্ণিমার জ্যোৎস্না, আমার সকাল, আমার রাত, আমার সুখস্বপ্ন, আমার চেতনার রোদ, আমার চামেলি, চন্দ্রমল্লিকা, আমার ভোরের শিশির, আমার রক্তিম পদ্ম।
আমি অঙ্গীকার করছি, যদি তুমি আসো, আমার আকাশে রোদ ফুটবে, চাঁদ উঠবে, মেঘগুলো হাসবে, দিগন্ত থেকে সুর ভেসে আসবে, তারাগুলো নেচে উঠবে, স্বপ্নলোকে পরী উড়বে, ফুলে ফুলে প্রজাপতি বেড়াবে।
যদি তোমাকে হারাই, আমার পৃথিবী বিরান হয়ে উঠবে, আমার গানগুলো সুর হারাবে, আমার পদ্মপুকুর সব শুকিয়ে যাবে, আমার আকাশ মেঘ হারাবে। দিনরাত আমার বাগানে ঝিঁঝিঁ ডাকবে, আমার বসন্ত শুনবে না কুহুঁ রব। আমার সূর্য অন্ধকারে ঢেকে যাবে।
আমি অঙ্গীকার করছি, তোমাকে সম্রাজ্ঞী করব, সাম্রাজ্য বানাব, স্বর্গকে ছিনিয়ে আনবো আমাদের পুষ্পশয্যায়, অমরকুঞ্জে বসে তুমি আমি বাজাবো নীল বাঁশি।
তুমি এসো। চিরদিন আমার এ অমরলোকে থেকো।
১৮.০৩.২০১৬
স্বপ্ন, স্মৃতি, মেঘ
একাঙ্কিকা, তুমি যতই হও না কেন আকাশ-নির্দেশী,
পরিবর্তিত এ আবর্তে আজও তোমাকেই স্বপ্নদেশে দেখি।
মাথার উপরে মেঘ উড়ে যায়, বুনো হাঁসের ঝাঁক উড়তে উড়তে
আড্ডায় মাতে, স্মৃতির পৃথিবীতে জমে স্বপ্নের মেঘ,
রূপকথার মত নীল বৃষ্টি ঝরে যায়, পুরনো প্রেমের
অবয়বে ধুলো জমে, নীল কথা অজানার জগতে হারায়।
লাল সন্ধ্যায় পশ্চিম দিগন্তে স্বপ্ন ডুবে, তন্দ্রালীন গল্পের শুরু
রাতকে আবিষ্ট করে, চাঁদের দু’হাতে শুকপাখি
চুমু খায়। আমরা দু’জন বসে থাকি
জ্যোৎস্না-ডোবা সবুজের মাঠে, একান্ত নিবিষ্ট মনে
পরস্পরকে খুঁজে আর আবৃত্তি করে। তারপর
স্বপ্নরাত গুটি গুটি পায়ে চলে যায়, কল্পনার নীল রথ
যাত্রাকে স্তব্ধ করে বিশ্রামের সময়
খুঁজে নেয়, তুমি আর আমি
চলে যাই ভিন্ন পথে, শুধু দু’জনের কাছে
থেকে যায় দু’গুচ্ছ রজনীগন্ধার মালা।
সেই স্মৃতি করোটির কক্ষে কক্ষে গাঢ় থেকে গাঢ় হয়,
অশ্রু বালিশে লেপ্টে, স্মৃতির ঐশ্বর্য দিয়ে
শব্দের সৌধ গড়ি, প্লাস্টার, ঝাড়বাতি লাগাই সেখানে।
ঘুমে চোখ নেমে পড়ে, ঘুম থেকে ঘুমে, এক স্বপ্ন থেকে
আরও গভীরতর স্বপ্নের পথে পথ হাঁটা
চলতে থাকে, আর স্তব্ধ রাত্রির নীলাকাশে
সব ফেরারি স্বপ্ন ও স্মৃতি মেঘ হয়ে ঘুরে।
১০.০৬.২০১৬
অন্তরাল
সে এক বনপরী, তার সবুজ স্বপ্নে শুধু নীল আকাশ, সাদা মেঘ,
ভোরের সজীব পাতা, লাল অগ্নিগিরি।
সবুজ পৃথিবীতে সে সহজ নিজস্ব অভ্যাসে
ঘুমায়। আমার ঈপ্সিত নারী থাকে প্যারিসের ক্লাবে,
বার্লিনের পাবে আর ঢাকার অদূরে
ফ্যান্টাসি কিংডমে। সে থাকে আমার দিনের
মাতাল স্বপ্নে, জ্বলজ্বলে আলোর রোশনাইয়ে ভরা
নীল আয়নার গোলকধাঁধায়।
ধাঁধায় হারিয়ে যাই, বনপরীর স্থির দুঃখে
সমস্ত আকাশ সমস্ত পৃথিবী কাঁদে।
জীবনকে মৃতসার করে তোলে
আত্মপ্রতারণার কালিক খেলায় নামি।
দূর দিগন্তের মত স্বপ্নপরী দূরে সরে যায়………..
২১.০৬.২০১৬
তুমি আমাকে একটি কথা দিয়েছিলে
তুমি আমাকে একটি কথা দিয়েছিলে।
সেই কথা সুর হয়ে, তাল হয়ে, পিয়ানোর সিম্ফনি হয়ে
ফুলে ফুলে, ঘাসে ঘাসে, অটবীর বাঁশে বাঁশে
রেখে গেছে নীল স্বাক্ষর। নদীতে, পাহাড়ে, হ্রদে, রক্তিম উপবনে
মুদ্রিত দেখা যায় তোমার সে’ সবুজাভ কথা।
মেঘের ভিড়ে ঢাকা শূন্য আকাশে
হংসবক হয়ে উড়ে যায়, তারপর অসীম দিগন্তে
নিজ পথ খুঁজে নেয়। আগ্নেয় পাহাড়ের ভেতরের আগুনে
সেই কথা শিখার মতই লাল দীপ্তিতে জ্বলে।
লেকের শুভ্র জলে এক ঝাঁক প্যালিকন
ঘন্টা দুই সাঁতরে তারপর
ডানা মেলে উড়ে যায় মেঘের ওপারদেশে
সেই কথা নিয়ে। আমার দিনে, রাতে, ঘুমের স্বপ্নে
রাত দিন তোমার সে’ উচ্চারিত শব্দগুচ্ছ শুনি।
হৃৎপিন্ডের নীল কুঠরিতে সেই কথা
আগুনের বিস্ফোরণ হয়ে ফেটে পড়ে, লেপ্টে যায়
মেঘে মেঘে, ঘাসে ঘাসে, গাছে, ফুলে আর নীলাকাশে।
তুমি আমাকে একটি কথা দিয়েছিলে…………
১৮.০৬.২০১৬
নির্দয় আকাশ
স্বপ্নের সারস শিশু নেচে নেচে খেলছিল সমুদ্রের পাশে।
শিশুটির স্বপ্ন নিয়ে নাচছিল মা সারসের
সত্তা ও ঘুম। তার স্বপ্ন উড়ে উড়ে ঘুরছিল মেঘে মেঘে,
অন্তহীন সমুদ্রের ঢেউয়ে, কালো ঝড়ে, আকাশের নীলে নীলে।
এখন সে’ মা সারস নেই। ঠিকানাহীন দিগন্তের পারে
ডানা মেলে চলে গেছে। ঢেউয়ে ভরা সমুদ্রের পাশে
অসহায় আর্তি নিয়ে নতুন দাঁড়িয়েছে সারস শাবক
উদ্ভ্রান্ত, অনিশ্চিত, একা।
২৩.০৬.২০১৬
জনৈক নায়িকার আর্তি
শ্লিষ্যতি চুমু খায় গালে
ডানা মেলা মেঘ। দিন ও রাতের স্বপ্নে ফুল ঝরে পড়ে
চৈত্রের বিকেলে।
বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোন চাড়া দেয়, স্বপ্নের শত শত গাছকে কাঁপিয়ে
বাতাসের আক্রোশ আসে।
রাতের আকাশে চাঁদ কালো হয়ে মরে যায়, আর
অভয়ারণ্য জুড়ে সন্ত্রস্ত নেকড়ে ডাকে।
আর আমার কালো চুল উড়ে। পোষা
নেকড়ে হয়ে হিংস্র জ্বরে ডেকে ফিরে সকল পুরুষ
আমার।
২৯.০৬.২০১৬
আমার আকাশে তুমি মেঘ
আমার আকাশে তুমি মেঘ, এসেছিলে উত্তর আকাশ থেকে
ফুলের পরাগের মত শূন্যে ভেসে ভেসে,
চলছো এ নীলাকাশে নিরুদ্দেশ যাত্রায়।
পৃথিবীতে পিরামিড, তাজমহল গড়া হয়, ক্ষয়ে যায়, তারপর
ভেঙে ধূলিস্যাৎ হয়, তুমি থেকে যাও নির্লিপ্ত শাপলার মত
স্মৃতির আবীর আকাশে, জ্যোতিষ্মান পুঞ্জ পুঞ্জ
মেঘ-বালিকা। ভোরের ম্লান দীপ্তি ছড়িয়ে
দুপুরের লাস্যময়ী রোদ আসে, বিকেলের বিদায়-মল্লার,
তারপর লাল সূর্যাস্তের ছটা। ঘুম নেমে আসে চোখে,
নীল স্বপ্নে মুখোমুখি বসে থাকি, শেষহীন গল্পের
আসর বসে, বাকি রাত দূরের তারার সাথে
অলস আড্ডার প্রহর, তারপর রাত শেষ হলে
আবার ভোরের আলো। নিত্যদিনের চিরচেনা আলো।
আর চিরচেনা তুমি, তোমার সত্তা, তোমার আকাশ,
তোমার ভেসে ফেরা আকাশে আকাশে
চিরন্তন আলোর স্বভাবে। মহাপৃথিবীর
ভোরের মুহূর্ত থেকে সূর্যাস্তের সময়-বলয়
আমার আকাশে তুমি মেঘ,
চিরন্তন মেঘ ………..
৫.০৭.২০১৬
অনন্তিম
হলুদ এক প্রজাপতি উড়ে গেল তরুণীর গাল
ছুঁয়ে দিয়ে। তার স্মৃতি ও স্বপ্নে এল নীলাকাশ, সাদা মেঘ,
পাহাড়, অরণ্য, বাঁশবন, হলুদাভ নদী, যাযাবর হাঁস।
স্বপ্নের মদে ডুব দিয়ে সে দেখে নিল সবুজের মাঠ,
পারস্য প্রাসাদ আর সোনার কাঠির স্পর্শে ঘুমন্ত রাজকুমারী।
প্রজাপতি উড়ে গিয়ে বসল তার নায়িকার পাশে,
তার সত্তা থেকে শুককীট আলোয় এল, তারপর সে হল
বৃশ্চিক – চন্দ্রমল্লিকার পাপড়িকে দিল নীল দংশন।
ক্রমে সে’ বৃশ্চিক হল রঙধনু প্রজাপতি, উড়ে নেচে
আরও অপত্যের ভিড়ে তার নীল স্বপ্ন নিভে গেল,
মৃত শব ক্ষয়ে ক্ষয়ে মৃত্তিকায় লুপ্ত হল,
রজনীগন্ধা সেই মৃত ডানা শুঁষে নিয়ে স্ব অস্তিত্বকে
আলোর দীপ্তিতে দিল ভরে, চাঁদ ডোবা কালো রাতে
আলোর প্রজাপতি সেই ফুলের অমৃত
পান করে আলোভরা দিনে নীল শূন্যে উড়ে গেল –
তারপর উড়ে উড়ে বসল এক কিশোরীর হাতে
এক মুহূর্তের জন্য। পতপত শব্দ করে চলল বেড়িয়ে
আনন্দের স্বপ্নসঙ্গীর খোঁজে। আর সেই অপাপবিদ্ধা
কিশোরীর মনোলোকে উঠল ভেসে
নদী, বন, তারালোক, কুয়াশার কুহকে ঢাকা পাহাড়,
মেঘনীলিমা……….
১০.০৭.২০১৬
একটি মেঘ
অমর্ত্য সন্ধ্যা। স্বপ্নের আকাশে ভেসে যেতে যেতে
একটি মেঘের সাথে দেখা হল।
সে ভেসে এসেছিল সূর্যাস্তের পশ্চিম দিগন্ত থেকে,
আর আমি মেঘ চাঁদ জাগা পূর্ব আকাশে।
তার সত্তা জুড়ে লাল আলোর ছটা।
সে আমার পাশ ঘেঁষে
একটুখানি ছুঁয়ে দিয়ে
চলে গেল।
পলাতকা সে মেঘকে ডেকে
বললাম, হারানো মেঘ, তুমি এসেছিলে আমার বিকেলে
সত্তাকে সূর্যাস্তের
ছোঁয়া দিতে। আর আমি এখানে নির্জনে
তোমার স্মৃতির রেশে কালো চাঁদ এঁকে এঁকে ঘুরি।
শুনে চাঁদ ডাইনির মত
হাসি দিল, রাতের কালো মেঘগুলো
বৃষ্টি ঝেরে দিল পৃথিবীতে।
আর আমার সত্তা জুড়ে সূর্যাস্তের শূন্য আকাশ।
১৩.০৭.২০১৬
রঙীন সূর্যাস্তের ছটা
তুমি মাটি
তুমি ঘাস
তুমিই আকাশ
তুমি স্তেপ
তুমি মরুভূমি
তুমি ফাল্গুনের কৃষ্ণচূড়া
তুমি বর্ষার কদম
সোনালী আকাশে তুমি মেঘ
তুমি শীতের একপশলা বৃষ্টি
তুমি বিকেলের মিষ্টি রোদ
তুমি হলুদ আলমন্ডা
আমার প্রথম ভোরের দীপ্তি
আমার আকাশে তুমি
রঙীন সূর্যাস্তের ছটা
১৫.০৭.২০১৬
দু’জনের কথা
তুমি আর আমি, পেছনে সূর্য অস্ত যায়
তুমি আর আমি, পেছনে মেঘ কাঁপে
তুমি আর আমি, পেছনে চাঁদ হাসে
তুমি আর আমি, পেছনে সাদা বক
উড়ে যায়
তুমি আর আমি, পেছনে রজনীগন্ধার
ঘুম পায়
তুমি আর আমি, শ্রাবণের বৃষ্টি চারপাশে
তুমি আর আমি, প্রেতের দল নাচে ত্রাসে
তুমি আর আমি, পেছনে বনলতা আর কালো ঝড়
তুমি আর আমি, স্বপ্নের নীল সৌরভ
তুমি আর আমি, বাঁশের বাগানে আলোড়ন
তুমি আর আমি, সোনালী স্মৃতির গাঢ় স্পন্দন
তুমি আর আমি, ক্লান্তিহীন চারটি চোখের রাতকাটা ভোর
তুমি আর আমি, স্বপ্নরাতের একটানা সুর
তুমি আর আমি, রক্তিম মেঘ বিষণ্ণ মেদুর
তুমি আর আমি, রাতের বনের গান
তুমি আর আমি, নিরন্তন অন্তহীনের অমর্ত্য সুখটান
৩১.০৭.২০১৬
অপেক্ষা
ছোট শিশু খেলতো তার মা’র পাশে বসে
তুলোর বিছানায়
বিকেলের ঘুম চলাকালে
সুপ্তিভঙ্গের স্বপ্নে।
বছর বছর গেল কেটে।
বৃদ্ধ শিশু বসা মা’র পাশে
যে আজ শুয়ে আছে সমস্ত আকাশ জুড়ে
চিরন্তন ঘুমে।
১৭.০৭.২০১৬
তুমি কেন বহু দূরে?
প্রেমিক।। তুমি কেন বহু দূরে?
সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে পশ্চিমের লাল সূর্য,
খোলা পায়ে হেঁটে ফিরছি বীচে,
একটু পরেই মলিন আকাশে উঠবে চাঁদ,
স্বপ্ন দেখবো – তুমি আর আমি
হাঁটছি জ্যোৎস্নায়, তারপর তন্দ্রা চলে গেলে
স্বপ্নভঙ্গের ব্যথা। বীচের উপরে ছড়ানো
মৃত শামুকের খোলগুলো আমাদের নিরস্তিত্ব
হৃদয়ের কঙ্কাল। সমস্ত রাত্রির আকাশে
পুঞ্জ পুঞ্জ দুঃখের মেঘ, পৃথিবীতে নেমেছে
ব্যর্থ স্বপ্নের আবীর সন্ধ্যা। গ্রহ জুড়ে
শুধু গ্লানি, শুধু ক্লেদ, শুধু নীল দংশন।
প্রেমিকা।। এই গ্লানি, এই ব্যথা আমার অস্তিত্ব জুড়ে
সৃষ্টি করেছে বিস্তৃত শূন্য লোক, তাকে
আমি বলি, ‘আলো হোক, মাটি হোক,
জল হোক, অন্তরীক্ষ হোক।’ তাই হল।
আকাশে আকাশে আলোর রাজত্ব ছুঁলো,
সাদা মেঘ, নীল বক উড়ে এসে
আমাদের নীল যাতনাকে দিল অন্য মাত্রা
অন্য উচ্চতায় – যদিও শ্লেষের ছন্দে।
এই ব্যথা, এই ব্যর্থ স্বপ্নের পীড়া জন্ম দিল সুর –
স্বপ্নের ডানা ছেঁড়া অনন্তিম সুর।
১৭.০৭.২০১৬
স্বপ্নভঙ্গের পরে
পৃথিবীর সমস্ত মানুষ
মরে গেছে, আমি জেগে আছি একা
নষ্ট পৃথিবীর
ধসে যাওয়া পথে পথে।
পৃথিবীর সমস্ত মানুষ
আজ নেই, আমি শুধু জেগে থেকে থেকে
তাদের কান্নার শব্দ শুনি, সারা গ্রহ এক প্রেতপুরী।
পৃথিবীর সবকিছু
মুছে গেছে, কোথাও কিছু আর নেই,
স্বপ্ন নেই, প্রেম নেই, কান্নার আর্তি নেই,
সুর নেই, ছবি নেই, গল্প নেই,
শুধু অনন্ত বৃষ্টির শব্দ, মৃত পৃথিবীর
শুধু স্মৃতি।
পৃথিবীর সমস্ত আলো
নিভে গেছে, সবকিছু আজ
নিরর্থক বলে মনে হয়।
অর্থহীন মাটি ও আকাশ, পাখি ও মেঘমল্লারের ধ্বনি,
অর্থহীন স্বপ্ন, স্মৃতি, সুর, প্রেম, দুঃখের সিম্ফনি,
অর্থহীন তাজমহল, রিওর পাহাড়ে
দাঁড়ানো খ্রিষ্টের মূর্তি।
৩০.০৭.২০১৬
রূপান্তর
নীল পরী উড়ে যায় মেঘের উপর দিয়ে
রোদের জ্যোৎস্নায়
পাতার উপরে বৃষ্টির নাচ
আলোকের নাচ
নীল পরী ডাইনি হয়ে অট্টহাসি হাসে
ঝাড়ুর উপরে চড়ে উড়ে যায় পাতালের সুড়ঙ্গে
ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে
পাতার উপরে বৃষ্টির নাচ
হাওয়ার নাচ
৩১.০৭.২০১৬
রঙ
লাল, নীল, রূপালী আকাশ।
স্বপ্নের বৃষ্টিতে করি স্নান।
গোলাপী, আবীর, সবুজ, মেজেন্ডা মেঘ সাঁতরে বেড়ায়,
তারপর স্বপ্নের গাঢ় নীল রোদ ঝরে পড়ে,
তুমুল আলোর বৃষ্টি।
পৃথিবীর সব রঙ রাত্রির ঘুমে দেয় হানা,
লাল-নীল প্রজাপতি, মেঘের ঝাঁক নেচে নেচে ফিরে।
একেকটি চেতনালোক অন্ধকারকে আলোকিত করে
মুহূর্তের ফেরে,
তারপর অপরিচিত
দিগন্তে হারায়। রঙীন ঘুড়ির লেবাস ধরে
স্তব্ধ আকাশের একেকটি ইচ্ছে
নিজেদের মধ্যে খেলা করে, আর খেলা শেষ হলে
নীল দরজা খুলে দেয় স্বপ্নলোক, স্বপ্নের রূপকুমারী।
রঙের আগ্রাসনে দিশেহারা মর্ত্যলোক
তন্দ্রায় শুধু দেখে অচেনা এক দেশ।
রঙীন বেলুনগুলো ফোলে ওঠে ফেটে যায়,
শুধু পড়ে থাকে
ছিন্নভিন্ন রবারের কয়েকটি স্মৃতি।
১২.০৮.২০১৬
ক্রান্তি
সে শুধু স্বপ্ন দেখে। তার দু’চোখের পাতা জুড়ে
আঁকা আছে সমুদ্রের ঢেউ, নীল বনের গান
আর পদ্মের উপরে শিশিরের স্পন্দন।
তার রাতের বিস্তীর্ণ ঘুম জুড়ে
আকাশ আর মেঘ আর নদী আর নীল-লাল পাখি।
একান্ত আবিষ্ট মনে
সে স্বপ্নের ঝরনাকে
চুমু খায়।
বুলডোজার ধেয়ে আসে, হাজারো পায়ের শব্দ হোমো ইরেক্টাসের
আদিম অরণ্য থেকে।
রজনীগন্ধার বনকে দুমড়ে দিয়ে
এগিয়ে আসছে বন্য উল্লাসে।
সে তার স্বপ্নের ঝরনাকে লাল সূর্যাস্তের আভা দিয়ে
আবৃত করে, পাহাড় নদী বন ঝরনা দিয়ে
নন্দনকানন আর অমরাবতী আঁকে।
হোমো ইরেক্টাস আরও কাছে
ধেয়ে আসে, তার পায়ের শব্দ
শোনা যায় খুব কাছে। সে’ বন্য আক্রোশ থেকে
তার সুমিষ্ট স্বপ্নকে আমি কী করে বাঁচাবো?
২১.০৮.২০১৬
একটি অদেখা স্বপ্ন
পৃথিবীর মৃত্যুর আগের রাতে খুব ঘুম পেল।
লাল ইট বিছানো রাস্তা ধরে হেঁটে গেলাম।
দু’পাশে পাইন অরণ্য,
একটু দূরে ঝরনা, একটি ছোট নদী,
শেষ বিকেলের সূর্য, সাদা সাদা মেঘ,
একটি ডাকবাংলো, তার থেকে বের হওয়া
সহাস্য এক মুখ
তুমি আর আমি
সমস্ত আকাশ জুড়ে মেঘ ডাকছে ডমরু-ডমরু-
২৫.০৮.২০১৬
কলাবতী
আকাশবাগানে মেঘপ্রজাপতি উড়ে
ঝাঁকে ঝাঁকে।
কলাবতীর ময়ূরপঙ্খী ডানা মেলে
দুধ সমুদ্রে,
তার রূপোর বৈঠা, হীরের হাল।
হাতির দাঁতের খাটে ভেতরে বেঘোরে
ঘুমায় কলাবতী।
তীরে এক অচিন দুর্গে নীল রাক্ষসী অট্টহাসি হাসে,
ফাঁকা দ্বীপে একচক্ষু দানবের
হুঙ্কার শোনা যায়।
কলাবতী বেঘোরে ঘুমায়,
তার চোখজুড়ে স্বপ্নিল মেঘের অরণ্য।
সমস্ত আকাশ জুড়ে দানবীর হাসি ফেটে পড়ে,
মেঘেরা চমকে ওঠে ভয়ে।
কলাবতীর ঘুমরাজ্যে শুধু খেলা করে নীলাকাশ, লাল মেঘ,
বিস্তৃত ঘাসের দেশ, রঙধনু, সাদা বক, বৃষ্টির সুমিষ্ট সুর…
গজদন্তের খাটে কলাবতী বেঘোরে ঘুমায়।
২.০৯.২০১৬
ঘাস ও পায়ের গল্প
শাড়ির আঁচলে ঢাকা দু’টি পা মসৃণ
হেঁটে যায়, নিচে শুধু পড়ে থাকে
ঘাসবন।
ওদিকে নীল মেঘ ডাকে, শিমুলের ডালকে কাঁপায়
উত্তরের হাওয়া।
আর্ডেনে উন্মত্ত সুরে
নাচে মত্ত ময়ূর।
দুই পা শুধু হেঁটে যায় ঘাসের উপর দিয়ে।
কখনো বা পেঁচা ডাকে, মেঘেরা লুকায়,
অন্ধকার গাছ জুড়ে বাঁদুড়ের আস্ফালন, আকাশে ভূতুড়ে চাঁদ
স্থিমিত, বিষণ্ণ।
ঘাসের উপর দিয়ে সে হেঁটে যায়।
রাতের ঘুমের স্বপ্নে হাজারো পায়ের
শোনা যায় পদক্ষেপ।
বিষণ্ণ হারানো শব্দে সে হেঁটে যায়।
১১.০৯.২০১৬
ঘুমকন্যা
শুস্তার জল থেকে দমকা হাওয়া ভেসে আসে,
আকাশে আকাশে মেঘের চিৎকার, ঠাঠা হাসি,
আর মৃদু মৃদু ব্যথা।
নদীর বিস্তীর্ণ জলে কচুরিপানার ফুল
ঝাঁকে ঝাঁকে, তার একটিতে ঘুমকন্যা
শুয়ে আছে, মনে হয় লক্ষ যুগ ধরে।
সে তার বেহুঁশ নীল ঘুমে দেখে
ঠাঠা মরা ভূতের চমকানি।
শুস্তার জল জুড়ে কচুরিপানার ক্ষেত,
আফিমের ঘ্রাণ আর
ঘুঁটঘুঁটে ঘুমের নিশ্বাস।
লক্ষ কচুরিপানার ফুলে
আর মৃত মেঘে
ছেয়ে আছে আদিম নির্বিকার ঘুম।
২৬.০৯.২০১৬
ফসিল
কফিনের বিছানায় শুয়ে আছে।
পৃথিবীর তান্ডবে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখতো কতো!
সকালের নীলাকাশে সূর্য উঠতো,
ভরে যেতো শিশিরের ঘ্রাণে
মাঠ আর শস্যের বিচালি।
ভোরের পাখির কণ্ঠে নীল স্বপ্নরাগ
গান গেয়ে যেতো এক অনাবিল সুরে।
ক্লান্ত পৃথিবীর রাতে আসর জমাতো
অজস্র তারা।
আর চাঁদ আর দীঘি আর ম্লান নীল জ্যোৎস্নার গান।
আর নির্বিকার ঘুম।
আর জীবন আর প্রেম আর আদিগন্ত স্বপ্নকুহক পানের
বিশীর্ণ তৃষ্ণা।
ঘুমন্ত এই শব আফিমও টেনেছে
কতো কাল।
এ আফিম তার স্বপ্নে উস্কে দিয়েছে কতো
স্বপ্নিল বিশ্ব থেকে ভিন্ন এক জগতের
রঙীন রূপকথা। সে স্বপ্নজগতে ডুবে থেকে থেকে
ধূসর ডাইরিতে বসে লিখে গেছে মোহভরা
প্রতারক আকাঙ্ক্ষার গান। স্বপ্নমোহে আবিষ্ট থেকে
নিজেকে করেছে নিঃস্ব, প্রবঞ্চিত, নির্বোধ জগতের
নিরস্তিত্ব নিবাসী।
আজ এই কবরের নীল অন্ধকারে
সেসবের কিছু আর
অবশিষ্ট নেই। আদিম অনন্তিম মাটির সমুদ্রে শুয়ে
তার ক্লান্ত অবসিত দেহ পচে পচে মিশে যাবে।
হাজার বছর পর নতুন এক কীটসন্ধানী
সেটা খুঁজে পাবে, সেখানে সে খুঁজে শুধু নেবে
কীভাবে নষ্ট এক জীব শুধু আফিমের ঘোরে
দৃশ্য ও অদৃশ্য স্বপ্নের মাঝে হারিয়ে ফেলেছে
অসহায় নিজেকে। দুই’ই অর্থহীন।
তার ফসিলকে শুঁষে শুঁষে বেড়ে উঠবে রজনীগন্ধা ফুল।
আকাশের চাঁদকে তা উৎসাহ দেবে, ভ্রমরের গুঞ্জন
রাত্রির গানের সাথে যুক্ত হবে, তারপর রাত শেষ হলে
সূর্য উঠবে ফের, স্বপ্ননীল সে’ ভ্রমর
দিনের সঙ্গীতে ফুল থেকে ফুলে উড়ে ছড়াবে আগ্রহে
পরাগের সাম্রাজ্য,
তারপর ছুঁয়ে যাবে হয়তো এক সুকান্ত তরুণের
স্বপ্নাবিষ্ট গাল, যারও অভিন্ন সেই
গদ্যময় ইতি সমাগত।
৩০.০৯.২০১৬
দুঃখ
আমি ক্রোধের বিকট স্বরে
চিৎকার দিয়ে উঠি, আর আমার নবজাত শিশু
ভয়ে কেঁপে উঠে, ত্রস্ত তার চোখে
সে দেখে তার ঘর, তার দোলনা, সমস্ত পৃথিবী
অসুরের হুঙ্কারে ভরে গেছে।
দেয়ালে হিংসামত্ত দানবের ছবি দেখে
সে জানতে পারে তার নেই নিস্তার
আদিম এক অরণ্যের দানবের থেকে।
দানবের পদশব্দ জড়সড় তার
স্বপ্নে হানা দেয়।
তাই সে শুধু সশব্দে কাঁদে
আর হাত-পা ছুড়ে ইঙ্গিতে বলে
পিতা, নির্দোষ আমাকে তুমি এ কোন অরণ্যে নিয়ে এলে?
২১.১০.২০১৬
পাপ
শিশু তার মাকে খোঁজে, মধ্যরাতের ঘুমে
অন্ধকারের নীল স্তূপে হাতড়ায়।
পাশে তার বৃদ্ধ পিতা শুয়ে আছে নির্বিকার
স্বপ্নহীন, লক্ষ্যহীন, অনিশ্চিত ভবিতব্যে
সমর্পিত, স্তব্ধ, অসহায়।
শিশু তার স্বপ্ন-ঘোরে মুখে অর্বাচীন
শব্দ করে হাঁটে, আর তার মাকে খোঁজে।
পাশে পিতা দৃষ্টিহীন, হাহাকারহীন।
শুক্লপক্ষের চাঁদ অস্তযাত্রী, ক্ষীয়মাণ।
৩.১১.২০১৬
সংশপ্তক
আমাদের শব্দভান্ডার ফুরিয়ে যায়,
তবু আমরা চেতনার চিরন্তন নাগরদোলায় নাচি।
আলোড়ক কিছু প্রশ্ন
সত্তাকে তাড়িত করে, আত্মার সীমিত দেয়ালে
ছোপ ছোপ কালো দাগ
অস্তিত্বের ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
চেতনার নীল কক্ষে মৃতপ্রায় বাতি জ্বলে,
আর সড়কে সড়কে ট্র্যাফিক সঙ্কেত রঙ বদলায়।
সিরিয়ায়, বার্মায়, নাসিরনগরে
বানরেরা মদ খেয়ে ধ্বংস-নাচ নাচে,
আর কলার চামড়া দিয়ে লন্ টেনিস খেলে।
তারা লাল, নীল গোলাপকে পায়ে মেড়ে সশব্দে ছুটে।
আমার নিস্পাপ নবজাতকের
ঘুম ভেঙে যায়।
নিস্প্রভ কর্তব্যবিমূঢ় চোখে
সে দেখে বানরের ধূসর উচ্ছ্বাস।
সে শুধু চেয়ে থাকে, নির্বাক বিস্মিত চোখে
সে শুধু চেয়ে থাকে।
তার এ বিমূঢ় দৃষ্টি বানরের হিংস্র উল্লাসের
চেয়ে শক্তিধর।
৯.১২.২০১৬
সন্ত্রাস
ছিন্নমস্তার ঠাঠা হাসি
কাঁপায়নি এ মনকে মোটেই।
হেঁটে গেছি নির্বিকার
গহীন বনের পথে অমাবস্যায়।
তাড়িয়ে ফিরেছে শুধু
একটি বিধ্বস্ত দুর্গ
আকাশে দুঃসহ চাঁদ
মেঘের ডম্বরু
নীলচে কুয়াশা
কালো জলের লেইক
একটি রূপালী ব্রিজ
মরা ফুলের ঘ্রাণ
তোমার ধ্রুপদী উপস্থিতি
৪.০১.২০১৭
Comments are closed